অতিথি পাখির কোলাহলে মুখর রাবি ক্যাম্পাস: শীতের আগেই প্রাণের উৎসব
- Author, রাবি প্রতিনিধি
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহেও মতিহারের সবুজ চত্বরে শীত পুরোপুরি আসেনি। বাতাসে এখনো গরমের আবেশ, দুপুরে রোদে খানিক তীব্রতা। তবু মৌসুমের আগমনী বার্তা যেন বহু আগেই অনুভব করেছে পরিযায়ী পাখিরা। সেই টানেই নভেম্বরের শুরু থেকে একের পর এক অতিথি পাখির আগমনে মুখর হয়ে উঠেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ক্যাম্পাসের জলাশয়, সবুজ প্রান্তর ও নীরব বাগানপথ।
প্রতিবারের ন্যায় এবারও উত্তর মেরুর দেশ সাইবেরিয়া, ফিলিপস, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ফিনল্যান্ড, উত্তর ইউরোপ, এন্টার্কটিকাসহ অনেক অঞ্চলে তাপমাত্রা যখন শূন্যের নিচে নেমে যায়, তখন সেখানে দেখা দেয় প্রচণ্ড খাদ্যাভাব। তীব্র শীতে সেখানে পাখির দেহ থেকে পালক খসে পড়ে। বেঁচে থাকার তাগিদে তুলনামূলক কম শীত ও অনুকূল প্রকৃতির দেশে পাড়ি জমায় পাখিগুলো। আর দক্ষিণ এশিয়ার নাতিশীতোষ্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিবছর সাদরে গ্রহণ করে নেয় এই অতিথিদের।
মঙ্গোলিয়া ও তিব্বতের মালভূমি এলাকার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দল বেঁধে এসেছে পানকৌড়ি, গার্গানি হাঁস, গাডওয়াল, নর্দার্ন শোভেলার, টিল, পাতিহাঁস, খয়রা হাঁস, ভুটটান হাঁস ও বিভিন্ন প্রজাতির স্যান্ডপাইপারসহ অন্তত ২৫ থেকে ৩০ প্রজাতির অতিথি পাখি। এই পরিযায়ী পাখিরা সাধারণত প্রায় ৬,০০০ থেকে ১৫,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসে, যা তাদের প্রাকৃতিক সহনশীলতার এক বিস্ময়কর প্রমাণ।
পাখি গবেষকদের মতে, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত রাবির বিভিন্ন জলাধার এসব পরিযায়ী পাখির নিরাপদ আশ্রয় হয়ে থাকে। মূলত সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে হাঁস জাতীয় পাখি ছোট সরালি, বড় সরালি, ল্যাঞ্জা হাঁস, খুন্তে হাঁস এবং ঝুঁটি হাঁস -এর মতো বৈচিত্র্যময় প্রজাতির আগমনও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
গাছগাছালিতে মোড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সারা বছরই মুখরিত থাকে অগণিত পাখির কলতানে। ক্যাম্পাসের প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে রহমতুন্নেসা হলের পুকুরপাড়, পশ্চিম পাড়ার টিচার্স কোয়ার্টারের পাশের জলাধার, বদ্ধভূমি, বিবিএ ভবনের পুকুর, মার্জিত গাছপালায় ভরা রোকেয়া হল সংলগ্ন সবুজ এলাকা এবং কৃষি অনুষদের পুকুর। এসবের পাশাপাশি বেগম খালেদা জিয়া হল, তাপসী রাবেয়া হল এবং শহীদ শামসুজ্জোহা হলের সংলগ্ন জলাশয়েও এদের ঝাঁক চোখে পড়ে।
সূর্য ওঠার প্রথম আলোয় এসব জলাশয় পেরিয়ে গেলে দেখা যায় পাখিদের অসংখ্য দল। কেউ পানিতে ডুব দিচ্ছে, কেউ ডানায় রোদ মেখে বিশ্রাম নিচ্ছে। দিনের মাঝামাঝি সময়ে তারা জলাশয়ের শাপলার পাতা বা জলজ উদ্ভিদের উপর পালকের ভেতর মুখ গুঁজে রোদ পোহায় এবং দলবদ্ধভাবে তাদের ডুবসাঁতার, জলকেলি ও নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করার দৃশ্য ক্যাম্পাসের প্রকৃতিতে এক চঞ্চল, প্রাণবন্ত উৎসবের সৃষ্টি করে। ছাত্র-ছাত্রীদের পদচারণা কম এমন জায়গায় সকাল ও সন্ধ্যায় পাখির উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি।
সকালে হাঁটতে বের হওয়া শিক্ষার্থী নাঈম হোসেন বলেন, শীত এখনো পুরোপুরি না এলেও পাখিরা এসে গেছে। সকালে পুকুরের ধারে হাঁটতে গেলে মনে হয় অন্য কোনো জগতে আছি। এই দৃশ্যই ক্যাম্পাসকে ঋতুর আলাদা সৌন্দর্য উপহার দেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আরিফ হাসান জানান, বিগত কয়েক বছরের রেকর্ড দেখলে বোঝা যায়, রাবি ক্যাম্পাসে অতিথি পাখির সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, নিরাপদ আবাসস্থল এবং ক্যাম্পাসে মানুষের সচেতনতার কারণে পরিযায়ী পাখিদের জন্য রাবি এখন তুলনামূলকভাবে ‘সেফ জোন’। গত দুই মৌসুমে এখানে প্রায় তিন হাজারের বেশি পাখি দেখা গেছে।
তিনি আরও বলেন, এই পাখিরা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে; তাদের বিষ্ঠা জলাশয়ের সার হিসেবে কাজ করে এবং ফসলের ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ দমনেও সাহায্য করে।
তবে পাখিপ্রেমীরা মনে করেন, অতিথি পাখিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ক্যাম্পাসে আরও কিছু পদক্ষেপ প্রয়োজন। অন্যান্য ক্যাম্পাসের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, বিশেষ করে জলাশয়ের চারদিকে শব্দদূষণ ও অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষের ভিড় কমানো উচিত। একই সঙ্গে মাছ ধরার জাল, প্লাস্টিক বর্জ্য ও আকস্মিক আলো, শব্দের উৎস বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো জরুরি। শিক্ষার্থীদেরও উচিত নিজেদের মোটরবাইকের হর্ন বা অতিরিক্ত শব্দ থেকে বিরত থেকে এই জীবন্ত পাঠশালার পরিবেশ বজায় রাখা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাহবুবর রহমান বলেন, ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে পাখি হত্যা নিষিদ্ধ। তাদের কোনো ধরনের ভয়-ভীতি দেখানো যাবে না। পরিযায়ী পাখির অবাধ বিচরণে যেন কোনো বিঘ্ন না ঘটে সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তৎপর রয়েছে।
ডিসেম্বরে শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে পাখির সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করছেন পাখিপ্রমীরা। মার্চের শেষদিকে আবহাওয়া উষ্ণ হয়ে উঠলে তারা আবার ফিরে যাবে নিজেদের চিরচেনা আবাসে। তার আগে রাবি ক্যাম্পাসই হয়ে উঠবে তাদের অস্থায়ী নিবাস। যেখানে প্রতিদিনই ফুটে উঠবে সৌন্দর্য, স্বাধীনতা আর প্রকৃতির অনাবিল সুর।
রাবির শিক্ষার্থীদের কাছে তাই এই মৌসুম শুধু অতিথি পাখি দেখার নয়; প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের প্রতি হৃদয়ে নতুন করে প্রেম জাগানোর সময়ও বটে। এই পাখিদের দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সারা বছর জলাশয়গুলোর পরিবেশ উন্নত ও পরিচ্ছন্ন রাখা অত্যাবশ্যক।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।