ঘরে তৈরি, কিন্তু স্বাদে বিশ্বজয়ী-মালয়েশিয়ান আয়াম গোরেং বেরেমপাহ রেসিপি যা সবাই পছন্দ করবে!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রন্ধন ইতিহাসে একটি খাবার আছে, যাকে এক কথায় মশলার বিস্ফোরণ বলা চলে। মালয় ও ইন্দোনেশীয় পরিবারের বহু প্রজন্ম ধরে এটি শুধু একটি রেসিপি নয়, একটি অভ্যাস, একটি গৃহস্থ সংস্কৃতি। ভাজা মুরগি তো অনেক দেশে আছে, কিন্তু মশলায় ভিজিয়ে সময় নিয়ে ভাজার এই পদ্ধতি স্বাদের এমন স্তর তৈরি করে যা একদিকে ঐতিহ্য, অন্যদিকে রান্নাবিজ্ঞানের সূক্ষ্ম কৌশলের প্রতিফলন। আজকের এই প্রতিবেদন শুধু রেসিপি নয়-মশলার ভৌত-রসায়ন, রান্নার পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া এবং স্বাদের জন্ম কোথায় তা ব্যাখ্যা করে আয়াম গোরেং বেরেমপাহকে নতুন চোখে দেখাবে।
মুরগিকে দীর্ঘক্ষণ মশলায় ভিজিয়ে রাখা এই রেসিপির প্রাণ। সাধারণ ভাজা মুরগির রেসিপি থেকে এর ভিন্নতা ঠিক এখানেই।
১. প্রোটিনের ডেন্যাচারেশন- হলুদ, আদা, রসুন, লবণ এবং লেবুর অম্লতা মুরগির পেশীভাগ খুলে দেয়। ফলে মশলার ক্ষুদ্র অণুগুলো ভেতর পর্যন্ত ঢুকে যায়। রান্নার পর মাংস হয় নরম, রসাল এবং গভীর স্বাদযুক্ত।
২. হলুদে থাকা কারকিউমিন, ধনে-জিরার তেলজাত যৌগ, লেমনগ্রাসের সিট্রাল - এসব উপাদান ভাজার পরও সুগন্ধ ধরে রাখে। তাই আয়াম গোরেং বেরেমপাহ ঠান্ডা হলেও স্বাদ কমে না।
৩. ভাজার সময় "মায়ার্ড রিঅ্যাকশন"- মশলা ও মুরগির প্রোটিনের মিলনে উচ্চ তাপে যে বাদামি রঙ ও গভীর স্বাদ তৈরি হয়, সেটিই মায়ের্ড। এই প্রতিক্রিয়ার কারণেই ভাজা মুরগির খাস্তা বাইরের স্তর তৈরি হয়।
কেন এই রেসিপিতে মশলা এত বেশি?
মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার রন্ধনভাষায় "বেরেমপাহ" মানেই বহুমাত্রিক মশলার ব্যবহার। এই অঞ্চলে লেমনগ্রাস, গালাঙ্গাল, হলুদ, ধনে-জিরা সহ নানা ভেষজের ব্যবহার বহু পুরোনো। এই রেসিপির বিশেষত্ব হলো-
◑ মশলা কেবল সুগন্ধ দেয় না,
◑ মাংসকে নরম করে,
◑ তেলকে সুগন্ধময় করে এবং
◑ ভাজার সময় ক্রিস্পি টেক্সচার তৈরি করে।
ফলে প্রতিটি কামড় স্বাদ ও গন্ধে স্তর তৈরি করে।
আয়াম গোরেং বেরেমপাহ-সম্পূর্ণ রেসিপি
উপকরণ (৪–৫ জনের জন্য):
⇨ মুরগি ১ কেজি (টুকরা করা)
⇨ রসুন ৬–৮ কোয়া বাটা
⇨ আদা ২ টেবিলচামচ বাটা
⇨ পেঁয়াজ ১টি বাটা
⇨ লেমনগ্রাস ১টি (হালকা ভেঙে কুচি)
⇨ শুকনা মরিচ গুঁড়া ১–২ চা-চামচ
⇨ ধনে গুঁড়া ১ টেবিলচামচ
⇨জিরা গুঁড়া ১ চা-চামচ
⇨হলুদ গুঁড়া আধা চা-চামচ
⇨গোলমরিচ গুঁড়া ১ চা-চামচ
⇨লবণ স্বাদ অনুযায়ী
⇨ লেবুর রস ২ টেবিলচামচ
⇨ ভাজার জন্য তেল
⇨ কারি পাতা (ঐচ্ছিক, কিন্তু সুগন্ধ বাড়ায়)
মেরিনেশন প্রক্রিয়া-
১) সব বাটা, গুঁড়া মশলা, লবণ ও লেবুর রস একসাথে ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে।
২) মুরগির প্রতিটি টুকরার উপর মশলা যেন সমানভাবে লেগে থাকে।
৩) কমপক্ষে ৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখা দরকার। সবচেয়ে ভালো ফল পেতে সারারাত ফ্রিজে মেরিনেট রাখা যায়।
এই দীর্ঘ মেরিনেশন মাংসকে সুগন্ধে পরিপূর্ণ করে এবং রান্নার সময় দ্রুত নরম হতে সাহায্য করে।
ভাজার ধাপ-
১) কড়াইয়ে পর্যাপ্ত তেল গরম করতে হবে।
২) তেল মাঝারি মাত্রার গরম হলে মুরগি দিতে হবে। খুব বেশি গরম তেলে দিলে বাইরেটা পুড়ে যাবে ও ভেতর কাঁচা থেকে যাবে।
৩) মাঝারি আঁচে ধীরে ভাজা- এটাই আসল রহস্য। এই ধীর ভাজাই মাংসকে ভেতর থেকে রসালো রাখে, আর বাইরে খাস্তা স্তর তৈরি করে।
৪) মুরগি যখন ৮০% ভাজা হয়ে যাবে, তখন আঁচ কিছুটা বাড়ানো যায়, যাতে সোনালি-বাদামি রঙ তৈরি হয়। চাইলে কারি পাতা আলাদা করে তেলে ছুঁইয়ে শেষে মুরগির উপর ছড়িয়ে দিতে পারেন।এতে সুগন্ধ আরও বাড়বে।
এটি এত জনপ্রিয় কেন?
বাইরের স্তর খাস্তা, ভিতরটা নরম- একই সাথে দুই টেক্সচারের অভিজ্ঞতা। মশলার ঘ্রাণ ও স্বাদ একাধিক স্তরে প্রকাশ পায়। প্রয়োজনে ভাত, ভাজা ভাত, লেমন রাইস কিংবা শুধু চাটনি দিয়েও খাওয়া যায়। ঠান্ডা হয়েও স্বাদ ধরে রাখে। তেলের মধ্যে মশলার সুগন্ধ মিশে আলাদা এক ধরনের অ্যারোমা তৈরি হয়।
পুষ্টিগুণ-
আদা ও রসুনের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল গুণ খাবার হজমে সহায়তা করে। হলুদের কারকিউমিন প্রদাহ কমাতে পরিচিত। লেমনগ্রাস পাচনতন্ত্রে আরাম দেয়। মাঝারি তাপে ভাজায় তেল কম শোষিত হয়, ফলে স্বাভাবিক ভাজা খাবারের তুলনায় তুলনামূলক কম তেল ধরে। এগুলো মিলিয়ে এই খাবার শুধুই ভাজা মুরগি নয়, মশলার সঠিক ব্যবহারে তৈরি স্বাস্থ্যসম্মত একটি ঐতিহ্যবাহী পদ।
আয়াম গোরেং বেরেমপাহ দেখায় রান্না কেবল উপকরণ মেশানো নয়। এটি সময়, ধৈর্য ও সঠিক কৌশলের শিল্প। ধীরে মেরিনেশন, ধীরে ভাজা, আর মশলার সূক্ষ্ম ব্যবহার এই সাধারণ মুরগিকে অসাধারণ একটি রন্ধন অভিজ্ঞতায় পরিণত করে। মালয়েশিয়ার ঘরোয়া রান্নাঘর থেকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া এই খাবারের জনপ্রিয়তার কারণ একটাই-স্বাদ তার নিজের টানে মানুষকে আকৃষ্ট করে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।