চিকুনগুনিয়া: হঠাৎ জ্বর, প্রচণ্ড ব্যথা! কারণ, উপসর্গ ও প্রতিকার জানুন একসাথে
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানুষের ইতিহাসে অসংখ্য রোগ এসেছে। কিছু ক্ষণস্থায়ী, কিছু ভয়াবহ। তবে কিছু রোগ আছে যেগুলো মৃত্যুর হার কম হলেও মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে ভীষণভাবে বিপর্যস্ত করে দেয় চিকুনগুনিয়া ঠিক সেই ধরনের একটি ভাইরাসজনিত অসুখ, যা মানুষকে মৃত্যুর ভয় না দিলেও দিন-রাতের স্বাভাবিক জীবনকে একেবারে হাঁটুতে বসিয়ে দিতে পারে।
এই রোগকে বিশেষভাবে ভয় পাই আমরা কয়েকটি কারণে-
প্রথমত, এর জ্বর খুব দ্রুত আসে এবং শরীরের জয়েন্টে এমন ব্যথা দেয় যে রোগী প্রায়ই পুরো শরীর নাড়াতে ভয় পায়।
দ্বিতীয়ত, এর কারণে পেশী দুর্বলতা, অবসাদ ও জয়েন্ট পেইন দীর্ঘদিন থেকে যায়।
তৃতীয়ত, এর বিস্তার খুব দ্রুত ও অনিয়ন্ত্রিত, বিশেষ করে বড় শহরগুলোতে।
চিকুনগুনিয়া কী?
চিকুনগুনিয়া (Chikungunya) হলো একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যেটির মূল বাহক Aedes aegypti এবং Aedes albopictus মশা, যারা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায়। এই ভাইরাসটির নাম এসেছে পূর্ব আফ্রিকার একটি ভাষা "মাকোন্দে" থেকে, যার অর্থ "বাঁকা হয়ে যাওয়া" বা "যন্ত্রণায় কুঁজো হওয়া"। কারণ রোগীরা এত তীব্র জয়েন্ট ব্যথায় ভোগেন যে হাঁটাচলায় শরীর প্রায়ই মোচড়ানো অবস্থায় থাকে। এই রোগ প্রথম চিহ্নিত হয় ১৯৫০–এর দশকে তানজানিয়ায়। পরে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ক্যারিবিয়ান, লাতিন আমেরিকা, ভারত, বাংলাদেশ - সব জায়গায় এর জোরালো বিস্তার দেখা যায়।
কীভাবে ছড়ায়?
চিকুনগুনিয়া ভাইরাস ছড়াতে পারে কেবল Aedes পরিবারের মশা। বিশেষভাবে-
১. Aedes আএগ্যপ্তি-
⇨ শহুরে এলাকায় বেশি
⇨ সাধারণত দিনের প্রথম ভাগে কামড়ায়
⇨ পানি জমে থাকা টবে, ড্রামে, কন্টেইনারে বংশবৃদ্ধি করে
২. Aedes আলবপিচতুস-
⇨ গ্রাম ও শহর, দুই পরিবেশেই টিকে থাকে।
⇨ কন্টেইনার, বনাঞ্চল, গাছের গোড়ায় পানি জমলে সেখানে জন্মায়।
এই দুই ধরনের মশাই দিনের বেলা সবচেয়ে সক্রিয় থাকে— সকাল ৯টা–১১টা এবং বিকাল ৩টা–৫টা।
সংক্রমণের ধাপ:
☞ কোনো আক্রান্ত ব্যক্তি যখন মশার কামড়ে রক্ত হারায়, মশা ভাইরাসটি নিজের শরীরে পায়।
☞ এরপর একই মশা অন্য কাউকে কামড়ালে ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করে।
☞ মানুষের শরীরে ঢুকেই ভাইরাসটি দ্রুত রক্তে ছড়িয়ে পড়ে।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- চিকুনগুনিয়া মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না, মশা ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যম নেই।
উপসর্গ:
চিকুনগুনিয়ার প্রথম ধাপ অত্যন্ত দ্রুতগতির। ভাইরাস শরীরে ঢোকার ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে।
১. হঠাৎ উচ্চ জ্বর এবং খুব দ্রুত ওঠে। সাধারণত ১০২–১০৪°F। কাঁপুনি বা শীত শীত ভাব থাকে।
২. তীব্র জয়েন্ট ব্যথা (Arthralgia) অনুভূত হয়। এটাই চিকুনগুনিয়ার সবচেয়ে কষ্টকর লক্ষণ। হাত, পা, কব্জি, হাঁটু, আঙুল সব জায়গায় ব্যথা। কখনো ফুলে ওঠা। হাঁটা বা হাত ওঠানো কঠিন হয়ে যায়। অনেকের ব্যথা কয়েক মাস পর্যন্ত থাকে।
৩. মাথাব্যথা, চোখ ব্যথা হয়। কপালের সামনে ও চোখের পেছনে চাপ অনুভব হয়।
৪. শরীরব্যথা ও প্রচণ্ড অবসাদ অনুভূত হয়। দুর্বলতা এত তীব্র হয় যে, রোগী বিছানা থেকে উঠতে পারে না।
৫. ত্বকে র্যাশ লক্ষনীয় হয়। কোমর, পিঠ, হাত-পায়ে লাল দাগ। সাধারণত জ্বরের পরে দেখা যায়।
৬. বমি ভাব বা হালকা ডায়েরিয়া হয়। পেটের সমস্যা কখনো কখনো জ্বরের সঙ্গে দেখা যায়।
৭. চোখ লাল হয়ে যায়। মৃদু লালচে ভাব, জ্বালা ও পানি ঝরা।
শিশু, বয়স্ক ও গর্ভবতী-কারা বেশি ঝুঁকিতে?
যদিও চিকুনগুনিয়া সাধারণত প্রাণঘাতী নয়, তবুও কিছু শ্রেণির মানুষ বেশি জটিলতায় ভোগেন-
◑ বয়স ৬৫ বছরের বেশি
◑ গর্ভবতী নারী
◑ নবজাতক
◑ ডায়াবেটিস রোগী
◑ উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগে আক্রান্ত
◑ দুর্বল ইমিউন সিস্টেম (যেমন ক্যানসার রোগী)
এদের ক্ষেত্রে ব্যথা বেশি হয়, জ্বর দীর্ঘস্থায়ী হয়, এবং আরোগ্যে সময় লাগে বেশি।
শরীরের ভেতরে কী ঘটে?
ভাইরাস রক্তে প্রবেশ করার পর দ্রুত lymph node, joints, muscle fibers এবং immune cells–এ আক্রমণ করে।
আক্রমণের ধাপ:
১. ভাইরাস শরীরে ঢুকেই রক্তে multiplication শুরু করে।
২. প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে প্রদাহ সৃষ্টি করে।
৩. এই প্রদাহের কারণেই জয়েন্ট ফুলে যায়, ব্যথা বাড়ে।
৪. শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে কারণ প্রচুর immune reaction শরীরকে দুর্বল করে।
এই ব্যথা অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হয় কারণ ভাইরাস জয়েন্ট টিস্যুতে lingering effect রেখে যায়।
চিকিৎসা:
দুঃখজনকভাবে, চিকুনগুনিয়ার কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ বা ভ্যাকসিন এখনও নেই। চিকিৎসা মূলত উপসর্গ কমানো এবং রোগীকে সুস্থ রাখার ওপর ভিত্তি করে।
১. জ্বর ও ব্যথা কমাতে-
◑ Paracetamol
◑ Ibuprofen (ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নয়)
◑ Naproxen (ব্যথা বেশি হলে)
২. পর্যাপ্ত পানি-
চিকুনগুনিয়ায় ডিহাইড্রেশন দ্রুত হয়।
◑ ORS
◑ পানি
◑ স্যুপ
◑ নারকেল পানি
৩. বিশ্রাম: এ রোগে শরীর এমনিতেই ভেঙে যায়। অতিরিক্ত কাজ করলে ব্যথা আরও তীব্র হয়।
৪. জয়েন্টের সাপোর্ট:
◑ হালকা গরম সেঁক
◑ হালকা স্ট্রেচিং
◑ ফিজিওথেরাপি (ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হলে)
৫. পুষ্টিকর খাবার:
◑ ভিটামিন–সি
◑ জিঙ্ক
◑ প্রোটিন
◑ ফল–সবজি
ইমিউনিটি বাড়াতে এসব খাবার উপকারী।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব, যা অনেকেই জানেন না!
চিকুনগুনিয়া শুধু একটি জ্বর নয়, কিছু মানুষের জন্য এটি দীর্ঘমেয়াদি ভোগান্তি তৈরি করতে পারে।
১. ক্রনিক জয়েন্ট পেইন: ৬ মাস বা ১ বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। কখনো কখনো রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের মতো অনুভূতি দেয়।
২. অবসাদ ও শক্তিহীনতা: কাজে মনোযোগ কমে যায়, শরীর সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
৩. ঘুমের সমস্যা: ব্যথার কারণে ঘুম ব্যাহত হয়।
৪. মানসিক চাপ: দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা অনেকের ক্ষেত্রে মানসিক সমস্যাও তৈরি করে।
প্রতিরোধ:
যেহেতু চিকুনগুনিয়ার নির্দিষ্ট চিকিৎসা বা ভ্যাকসিন নেই, তাই প্রতিরোধই সবচেয়ে শক্তিশালী কৌশল।
১. Aedes মশার বংশবৃদ্ধি বন্ধ করুন।
⇨ ঘরের ভেতর-বাহিরে যেখানেই পানি জমে থাকতে পারে—সব ফেলে দিন
⇨ ফুলের টব
⇨ AC–এর পানি
⇨ ফ্রিজ ট্রে
⇨ ড্রাম
⇨ কন্টেইনার
⇨ পুরনো টায়ার
এসব সব সপ্তাহে একবার পরিষ্কার করুন।
২. দিনে মশারি ও রিপেলেন্ট ব্যবহার: কারণ Aedes দিনের বেলায় কামড়ায়।
৩. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ:
◑ ড্রেন
◑ নর্দমা
◑ আবর্জনার কৌটা
- সব নিয়মিত ঢেকে রাখুন।
৪. ঘরের জানালায় নেট লাগানো: নেট মশা ঢোকার সুযোগ কমায়।
৫. হালকা রঙের পোশাক: গাঢ় রঙের পোশাকে Aedes বেশি আকৃষ্ট হয়।
শহরে কেন রোগটি এত দ্রুত ছড়ায়?
চিকুনগুনিয়া শহুরে রোগ এর পেছনে কয়েকটি পরিষ্কার কারণ আছে—
⇨ জনসংখ্যার ঘনত্ব
⇨ পানি জমে থাকা জায়গা বেশি
⇨ অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
⇨ Aedes aegypti শহরের আবহাওয়ায় সবচেয়ে সুবিধা পায়
⇨ মানুষ দিনের বেলায় বাইরে থাকে। এতে মশা কামড়ানোর সুযোগ বেশি
এ কারণে ঢাকা, কলকাতা, দিল্লি, কুয়ালালামপুর, জাকার্তা- সব বড় শহরেই রোগটির জোরালো আক্রমণ দেখা যায় ।
চিকুনগুনিয়ার সময় রোগীর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন-
বিশ্রাম, সঠিক সময়ে ব্যথানাশক, পুষ্টিকর খাবার, মশা থেকে সুরক্ষা। ব্যথার কারণে রোগীদের মানসিক অবস্থা হতাশ হয়ে যেতে পারে। পরিবার যদি ধৈর্য ধরে পাশে থাকে, রোগী দ্রুত সুস্থ হয়।
চিকুনগুনিয়া মহামারি কেন ঘন ঘন বাড়ছে?
পৃথিবীর উষ্ণায়ন, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন, বৃষ্টির প্যাটার্নের পরিবর্তন সব মিলেই Aedes মশার জন্ম বাড়ছে। শহরে পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা রোগটিকে আরো তীব্র করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দশকে চিকুনগুনিয়া আরও বাড়তে পারে, তাই এখন থেকেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্ত করতে হবে।
চিকুনগুনিয়া কোনো রহস্যময় রোগ নয়। ইতি অত্যন্ত পরিচিত, অত্যন্ত কষ্টদায়ক, এবং দ্রুত ছড়ায় এমন একটি ভাইরাস। মৃত্যুর ঝুঁকি কম হলেও মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত নষ্ট করে দিতে পারে। এই রোগ আমাদের তিনটি স্পষ্ট শিক্ষা দেয়—
১. নগর পরিবেশ পরিষ্কার রাখা শুধু স্বাস্থ্য নয়, জীবনরক্ষার অংশ।মশা দমনই একমাত্র কার্যকর প্রতিরোধ।
২. ব্যথাকে হালকা করে দেখা যাবে না চিকুনগুনিয়ার ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, তাই সঠিক বিশ্রাম এবং চিকিৎসা অপরিহার্য।
৩. সচেতনতা ও নিয়মিত যত্নই সুস্থতার পথে এগোনোর মূল শক্তি। ভাইরাসকে পুরোপুরি হারানোর ক্ষমতা মানুষের ইমিউন সিস্টেমেরই আছে— তাকে শুধু সঠিকভাবে সময় দিতে হয়।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।