Blockchain: সাপ্লাই চেইনের লুকানো খরচ, গোপন ফাঁকফোকর ও প্রতারণাকে তুলে ধরার শক্তিশালী অস্ত্র!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বিশ্বজুড়ে সরবরাহ ব্যবস্থার কথা উঠলেই এখন এক নতুন শব্দ ক্রমশ বেশি শোনা যায় ব্লকচেইন। একসময় এটি কেবল ডিজিটাল মুদ্রার প্রযুক্তি হিসেবে পরিচিত ছিল, কিন্তু আজ বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা, ওষুধ সরবরাহ, পোশাকশিল্প, লজিস্টিকস, কাস্টমস সবখানেই ব্লকচেইন নতুন মানদণ্ড তৈরি করছে। কেননা, বিশ্বজুড়ে সরবরাহ চেইন আজ এমন এক পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে সবচেয়ে বড় চাহিদা স্বচ্ছতা, আস্থা এবং দুর্নীতি বা ভুল কমিয়ে আনার সক্ষমতা। আর এসবের বুনিয়াদ গড়ে দিচ্ছে ব্লকচেইন।
আমরা প্রতিদিন যে খাবার খাই, যে পোশাক পরি, যে ওষুধ ব্যবহার করি, এসবের কোথা থেকে যাত্রা শুরু, হাতে পৌঁছাতে কত ধাপ অতিক্রম করে, কারা এগুলো স্পর্শ করে, এগুলো জানার সুযোগ সাধারণ মানুষের ছিল না। এমনকি কোম্পানিগুলোর অনেক ক্ষেত্রেও এই তথ্য সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে পাওয়া মুশ্কিল। এই অদৃশ্যতার মধ্যেই জন্ম নেয় জালিয়াতি, ভেজাল, চোরাচালান, নকল পণ্য, এবং অনিয়ম। ঠিক এখানেই ব্লকচেইন এসেছে বদলে দিতে পুরো খেলা। এটি এমন প্রযুক্তি, যেখানে একবার কোনো তথ্য যুক্ত হলে তা আর পরিবর্তন করা যায় না। ফলে স্বচ্ছতা এবং আস্থার স্তর তৈরি হয় অভূতপূর্ব। সরবরাহ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা শুধু বিলাসিতা নয়। এটি জীবন বাঁচানোর বিষয়ও হতে পারে। খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে নকল উপাদান, পোশাকশিল্পে শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন- এসব পর্যবেক্ষণে সঠিক ট্র্যাকিং অত্যন্ত জরুরি। ব্লকচেইন এই নজরদারিকে করে তুলছে যান্ত্রিক, নির্ভুল, অটোমেটেড এবং সবচেয়ে বড় কথা-বিশ্বাসযোগ্য।
ব্লকচেইন যেভাবে কাজ করে-
১. লেনদেনগুলো ব্লকে যুক্ত হয়। যে কোনো পণ্য সরবরাহের ধাপে প্রতিটি তথ্য (যেমন উৎপাদনের তারিখ, কারখানার অবস্থান, পরিবহনের ধাপ) একটি ব্লকে যুক্ত হয়।
২. প্রতিটি ব্লক আগের ব্লকের সঙ্গে যুক্ত থাকে। অর্থাৎ পুরো যাত্রাপথ একটি ভাঙাহীন শৃঙ্খল হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়, যেখানে কিছু গোপন বা পরিবর্তন করা অসম্ভব।
৩. সব পক্ষ একই তথ্য দেখতে পারে। উৎপাদক, পরিবহন কোম্পানি, কাস্টমস, খুচরা বিক্রেতা সবার কাছে একই ডেটা থাকে। এর ফলে কেউ তথ্য লুকাতে বা বদলাতে পারে না। ভুল ধরা পড়ে দ্রুত।ফলে জালিয়াতির সুযোগ কমে। এমনকি ভোক্তাও মোবাইল স্ক্যান করলেই দেখে নিতে পারে তার পণ্য কোথা থেকে এসেছে।
সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্লকচেইনের প্রধান সুবিধা
১. সম্পূর্ণ ট্রেসেবিলিটি (একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নজরদারি)! সাপ্লাই চেইনের সবচেয়ে বড় সমস্যা তথ্যের বিচ্ছিন্নতা। ব্লকচেইন তা দূর করে। উদাহরণ: কোনো খাদ্যের উৎস কোথায়? কোন খামারে উৎপাদন হলো? কে পরিবহন করল? কোন গুদামে সংরক্ষণ হলো?- প্রতিটি ধাপই দৃশ্যমান হয়।
২. খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশ্বে খাবার নষ্ট হওয়া বা খাবারজনিত অসুস্থতার বড় কারণ - ট্রেসিং ব্যর্থতা। ব্লকচেইন খাদ্য দূষণ ঘটলে কয়েক সেকেন্ডে উৎস খুঁজে বের করতে পারে। আগে যা করতে লাগত দিন, ব্লকচেইনে লাগে মিনিট। চেইন যত স্বচ্ছ হয়, ভেজাল কমে, মান বাড়ে।
৩. নকল পণ্য রোধ। ফার্মাসিউটিক্যালস, বিলাসবহুল পণ্য, ইলেকট্রনিক্স- এসব শিল্পে জালিয়াতি ভয়াবহ। ব্লকচেইনে প্রতিটি পণ্যের ডিজিটাল আইডি থাকে। ফলে নকলকারীরা মাঝপথে ঢুকতে পারে না।
৪. কাগজপত্র-মুক্ত লেনদেন ও দ্রুততা। বিল অব লেডিং, আমদানি-রপ্তানির কাগজ- এসব আনুষ্ঠানিকতা বাণিজ্যে বিশাল সময় নষ্ট করে। ব্লকচেইনের স্মার্ট কন্ট্রাক্ট এই কাজকে স্বয়ংক্রিয় করে।
৫. পরিবহন ব্যবস্থার সঠিক ডেটা: কোন ট্রাকে পণ্য গেল, কখন পৌঁছাল, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ সঠিক ছিল কি না- এগুলো এখন মুহূর্তে জানা যায়।
৬. খরচ কমানো। মান খারাপ হওয়া, পণ্য হারানো, কাস্টমসে বিলম্ব এসব সমস্যায় কোম্পানির বড় ক্ষতি হয়। ব্লকচেইন এই ক্ষতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সক্ষম।
চাপের মুখে পড়া সরবরাহ ব্যবস্থা ব্লকচেইনের আগমনের প্রয়োজনীয়তা। আজকের বিশ্বায়িত পরিবেশে এক দেশের সমস্যা দ্রুতই অন্য দেশের ব্যবসায় ছড়িয়ে পড়ে। মহামারি, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্দর জট, জ্বালানি সংকট- এসবের কারণে সাপ্লাই চেইন ভেঙে যায়। ব্লকচেইন এসব সংকটের সময়ে কোম্পানিগুলোকে দেয়-
⇨ রিয়েল-টাইম ডেটা
⇨ সঠিক পূর্বাভাস
⇨ দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা
ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকে, ভোক্তার ক্ষতি কমে।
বিভিন্ন শিল্পে ব্লকচেইনের ব্যবহার:
১. খাদ্য ও কৃষি: দুধ, মাংস, মাছ, ফল ইত্যাদি দ্রুত নষ্ট হয়। ব্লকচেইন পরিবহনে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থ হলে সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক করে।
২. ওষুধ শিল্প: নকল ওষুধ রোধে ব্লকচেইন বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত। ফার্মা সাপ্লাই চেইনে ডোজ, ব্যাচ নম্বর, উৎপাদনকারী- সব ডেটা সুরক্ষিত থাকে।
৩. পোশাকশিল্প: বিশেষত বাংলাদেশে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে স্বচ্ছতা মানে শ্রমিক অধিকার রক্ষাও নিশ্চিত করা।ব্লকচেইন দেখাতে পারে— কাপড় কোথায় তৈরি? কে সেলাই করেছে? পরিবেশবান্ধব ছিল কি না!
৪. লজিস্টিকস ও পরিবহন: বন্দর–নির্ভর ব্যবসায় কাগজপত্রের ভুল প্রায়ই বড় ক্ষতি করে। ব্লকচেইন তা কমিয়ে দেয়।
৫. ই-কমার্স: ডেলিভারি ট্র্যাকিং আরও নির্ভুল হয়। রিটার্ন জালিয়াতিও কমে।
ব্লকচেইন প্রয়োগের চ্যালেঞ্জ:
যদিও সুবিধা অসংখ্য, বাস্তব প্রয়োগে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে-
১. প্রযুক্তির খরচ: উন্নয়নযাত্রায় প্রথম ধাপগুলো ব্যয়বহুল হতে পারে।
২. সকল পক্ষের আগ্রহ দরকার: ব্লকচেইন সফল করতে হলে উৎপাদক থেকে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত সবাইকে যুক্ত হতে হয়।
৩. দক্ষ জনবল প্রয়োজন: এই প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনায় বিশেষজ্ঞ লোকের প্রয়োজন।
৪. ডেটা রূপান্তর সমস্যা: পুরোনো পদ্ধতি থেকে নতুন ডিজিটাল লেজারে যেতে সময় লাগে। তবে প্রযুক্তিটি যত বেশি ব্যবহার হচ্ছে, খরচ ও জটিলতা ততই দ্রুত কমে যাচ্ছে।
আগামী দিনগুলোতে বিশ্ব অর্থনীতি স্বচ্ছতার উপর নির্ভরশীল হবে। ভোক্তা এখন জানতে চায়- "আমি যে জিনিসটি কিনলাম, তার পেছনের গল্প কী?" ব্লকচেইন সেই গল্পটিকে সত্য, স্পষ্ট এবং সহজলভ্য করে তুলছে। ভবিষ্যতের সাপ্লাই চেইন হবে-
◑ রিয়েল-টাইম
◑ ডেটা-চালিত
◑ স্মার্ট কন্ট্রাক্ট নিয়ন্ত্রিত
◑ জালিয়াতি ও ভেজাল মুক্ত
◑ পরিবেশবান্ধব উৎপাদন নিশ্চিতকারী
এমন একটি ব্যবস্থায় প্রতিটি ধাপই হবে প্রমাণযোগ্য, নির্ভুল এবং সবার কাছে দৃশ্যমান।
দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল জটিল, অস্বচ্ছ এবং ত্রুটিপূর্ণ। ব্লকচেইন এসে দেখিয়ে দিয়েছে প্রযুক্তি শুধু গতি বাড়ায় না, আস্থাকে প্রতিষ্ঠানগত মানে রূপ দিতে পারে। পণ্য কোথায় তৈরি হলো, কোন পরিবেশে হলো, কে পরিবহন করল—এই প্রশ্নগুলো শুধু তথ্যের বিষয় নয়। এগুলো মানবিকতা, নিরাপত্তা, এবং ব্যবসায়ের নৈতিকতারও প্রতিচ্ছবি। ব্লকচেইন সেই প্রতিচ্ছবিকে করছে পরিষ্কার, বিশ্বস্ত এবং অপরিবর্তনীয়। অতএব, বলা যায়, সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্লকচেইন শুধু প্রযুক্তি নয়, এটি ভবিষ্যতের গ্লোবাল ট্রাস্ট–ইনফ্রাস্ট্রাকচারের ভিত্তির ইট।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।