ফারমেন্টেশনের টক–ঝাল স্বাদের আড়ালে লুকানো গভীর স্বাস্থ্যজ্ঞান! কিমচিকে কেন 'সুপারফুড' বলা হয়, জানুন

ফারমেন্টেশনের টক–ঝাল স্বাদের আড়ালে লুকানো গভীর স্বাস্থ্যজ্ঞান! কিমচিকে কেন 'সুপারফুড' বলা হয়, জানুন
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

এক বাটি গরম ভাতের সঙ্গে কিমচি—দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিটি বাড়ির নিয়মিত দৃশ্য। কিন্তু এটি শুধু একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার নয়; এর প্রতিটি চামচ যেন মানবদেহের ইমিউন সিস্টেমে চুপিসারে কাজ করা ক্ষুদ্র সৈনিকদের বাহিনী। ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়ায় তৈরি কিমচি আজ বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যের আলোচনায় একটি দৃঢ় অবস্থান তৈরি করেছে।

কিমচি হলো হাজার বছরের! কোরিয়ান খাদ্যসংস্কৃতির ফল

কিমচির উৎপত্তি প্রায় দুই হাজার বছরের পুরোনো। তখন শীতকালে টাটকা সবজি সংরক্ষণের জন্য মানুষ নোনা ও ফারমেন্টেশনের পথ বেছে নিয়েছিল। সময়ের সাথে এই সংরক্ষণের কৌশল পরিণত হয়েছে স্বাদ, পুষ্টি ও বিজ্ঞানের মেলবন্ধনে। বর্তমানে ২০০+ প্রকারের কিমচি পাওয়া যায়। সবচেয়ে প্রচলিত ভ্যারাইটি— 

⇨ Napa cabbage Kimchi

⇨ Radish Kimchi

⇨ Green onion Kimchi

⇨ Young radish Kimchi
 

যদিও অঞ্চল, ঋতু, পরিবারের নিজস্ব অভ্যাস অনুযায়ী কিমচির উপকরণ ও স্বাদ ভিন্ন হতে পারে  একথা আজও সম্পূর্ণ সত্য।

কিমচির স্বাস্থ্যগত শক্তির আসল রহস্য লুকিয়ে আছে এর ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়ায়। প্রাকৃতিকভাবে উপস্থিত ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যাকটেরিয়া (LAB) ফারমেন্টেশনের সময় দ্রুত সক্রিয় হয় এবং সবজির ভেতরে প্রোবায়োটিকের মতো কাজ করা অসংখ্য উপকারী ব্যাকটেরিয়া তৈরি করে।

 

ফারমেন্টেশনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ-

১. নুন দেওয়া: সবজির ভেতরের অতিরিক্ত পানি বেরিয়ে আসে, টেক্সচার শক্ত থাকে।

২. মশলা ও পেস্ট মেশানো: রসুন, আদা, মরিচ, ফিশ সস বা সয়াবেসড পেস্ট ব্যাকটেরিয়ার জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে।

৩. অক্সিজেনহীন পরিবেশে রেখে দেওয়া: এখানে LAB সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় বৃদ্ধি পায় এবং উৎপন্ন হয় ল্যাকটিক অ্যাসিড, যা কিমচিকে টক, সুগন্ধি ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল করে তোলে।

এই প্রক্রিয়ায় খাদ্য শুধু দীর্ঘদিন টিকে থাকে না; বরং পাচনতন্ত্র ও ইমিউন সিস্টেমের জন্য এক শক্তিশালী প্রাকৃতিক থেরাপিতে পরিণত হয়।
 

ইমিউন সিস্টেমে কিমচির প্রভাব-

১. প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়ার শক্তি!ফারমেন্টেশনের সময় কিমচিতে তৈরি হয় অসংখ্য উপকারী ব্যাকটেরিয়া।
এগুলো-

অন্ত্রে "গুড ব্যাকটেরিয়া" বাড়ায়। ক্ষতিকর জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ তৈরি করে, ইমিউন সেল সক্রিয় করে, প্রদাহ কমায়, হজম শক্তি বাড়ায়। মানবদেহের ইমিউন সিস্টেমের প্রায় ৭০% অংশ অন্ত্রের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত, এ কারণে কিমচির এই প্রভাব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

 

২. Vitamin C, Beta-carotene ও Antioxidants: কিমচিতে ব্যবহৃত বাঁধাকপি, মুলো, মরিচ, রসুন সবগুলোই অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ।
এগুলো-

◑ কোষের ক্ষয় রোধ করে

◑ ভাইরাস–ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বাড়ায়

◑ সর্দি–কাশির ঝুঁকি কমায়

◑ মৌসুমি অসুস্থতা প্রতিরোধে সাহায্য করে

 

৩. Garlic & Chili-প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক শক্তি

রসুনে থাকা অ্যালিসিন এবং লাল মরিচে থাকা ক্যাপসাইসিন-ফারমেন্টেশনের ফলে আরও সক্রিয় হয়ে যায়। এই দুই উপাদান দেহে—

⇨ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রভাব

⇨ রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি

⇨ উষ্ণতা বৃদ্ধি

⇨ প্রদাহ কমানো

ভাইরাল সংক্রমণের প্রতিরোধ সবকিছুতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

 

৪. ফাইবার, অন্ত্রের স্বাধীনতা!

কিমচির ফাইবার সমৃদ্ধ গঠন- কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, গ্যাস–ব্লোটিং কমায়, অন্ত্রের নড়াচড়া স্বাভাবিক রাখে,ক্ষুধা বাড়ায়। রক্তে গ্লুকোজের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণ করে। ফাইবার-সমৃদ্ধ ফারমেন্টেড খাবার ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করার এক সাশ্রয়ী ও প্রাকৃতিক উপায়।

 

অন্য অনেক গবেষণায় দেখা গেছে-
প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাদ্য নিয়মিত খেলে স্ট্রেস ও উদ্বেগের স্তর কমে। অন্ত্র–মস্তিষ্ক সংযোগ (gut–brain axis) এর মাধ্যমে প্রোবায়োটিক স্নায়ুতন্ত্রে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে-

মুড ভালো থাকে, ঘুমের উন্নতি হয়। শক্তি বৃদ্ধি পায়। এক কথায়-এক চামচ কিমচি শুধু শরীরকেই নয়, মনকেও সজীব করে।
 

কিমচি খাওয়ার পদ্ধতি-কোরিয়ান ঘরোয়া ধারা

কোরিয়ার মানুষ কিমচিকে শুধু সাইড ডিশ হিসেবে নয়; বরং দৈনন্দিন খাদ্যসূচিতে নানা রূপে ব্যবহার করে—

◑ ভাতের সঙ্গে

◑ নুডলসের পাশে

◑ স্যুপে

◑ প্যানকেকের সঙ্গে

◑ কিমচি ফ্রাইড রাইস

◑ স্টিমড ডাম্পলিংয়ের সাথে

◑ সালাদে
 

ফারমেন্টেশনের মাত্রা বাড়লে এর স্বাদ আরও তীব্র হয়, যা অনেকেই রান্নায় ব্যবহার করতে পছন্দ করেন।
 

নতুনদের জন্য কিমচি খাওয়ার পরামর্শ

১. প্রথমে অল্প পরিমাণে শুরু করুন।

২. খুব টক বা খুব ঝাল কিমচি প্রথমবার এড়িয়ে চলুন। 

৩. পেটে সমস্যা থাকলে অতিরিক্ত খাওয়া ঠিক নয়।

৪. দীর্ঘদিন সংরক্ষিত কিমচির গন্ধ তীব্র হতে পারে, স্বাভাবিক।

৫. বাড়িতে বানানোর সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 
 

কেন বিশ্বজুড়ে কিমচি এখন 'Health Trend' হিসেবে জনপ্রিয়?

১. ফারমেন্টেড খাবারের চাহিদা বাড়ছে।

২. ইমিউন–বুস্টিং খাবার নিয়ে সচেতনতা।

৩. প্রোবায়োটিকের প্রাকৃতিক উৎস খোঁজ।

৪. কোরিয়ান সংস্কৃতি ও K-food এর বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা। কম ক্যালরিতে পুষ্টি বেশি,স্বাদের বৈচিত্র্য ।  

-এ কারণেই কিমচি এখন শুধু কোরিয়ান নয় আন্তর্জাতিক সুপারফুড।
 

কিমচি  মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় এক যুগান্তকারী প্রভাব ফেলে। ফারমেন্টেশনের বিজ্ঞান, সবজির পুষ্টি, প্রোবায়োটিকের ক্ষমতা সব মিলিয়ে কিমচি এমন এক খাবার, যা শরীরকে ভেতর থেকে শক্ত করে গড়ে তোলে।যে যুগে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, স্ট্রেস সবকিছুই স্বাস্থ্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, সেখানে কোরিয়ান কিমচি যেন এক সহজ, সাশ্রয়ী ও প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা "রান্নাঘরের একটা ছোট বাটিতেই লুকানো ইমিউনের বড় রহস্য।"

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ