এই ক্ষুদ্র দলা কেন গলায় আটকে বড় সমস্যা তৈরি করে? টনসিল স্টোনের নেপথ্যের সত্য নিয়ে আলোড়ন !
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
হঠাৎ গলা খুসখুস করছে, কথা বলতে গেলে মনে হচ্ছে কিছু একটা আটকে আছে, আর নিঃশ্বাসে অচেনা গন্ধ! অনেকেই এগুলোকে সাধারণ সমস্যার অংশ ভেবে এড়িয়ে যান। কিন্তু গলার দুই পাশের টনসিলের ছোট ছোট গহ্বরে জমে থাকা সাদা বা হলদেটে দানাদার শক্ত দলাগুলোই অনেক সময় এই অস্বস্তির মূল কারণ। এদের বলা হয় Tonsil Stone, বাংলায় যাকে সাধারণত বলা হয় টনসিলের দলা, টনসিল স্টোন বা টনসিলের পাথর।
নাম শুনলে বড় কিছু মনে হলেও এই দানাগুলো আকারে খুব ছোট। তবু এর প্রভাব যথেষ্ট বিরক্তিকর। গলার স্বাভাবিক স্বাস্থ্যে বাধা, দুর্গন্ধ, মাঝে মাঝে ব্যথা সবই ঘটতে পারে এর কারণে। কিন্তু কেন এগুলো তৈরি হয়? কীভাবে? আর এগুলো কি সত্যিই বিপদজনক? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই তুলে ধরা হলো গভীর ও তথ্যসমৃদ্ধ বিশ্লেষণে।
টনসিল স্টোন কী?
টনসিল আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একটি অংশ। গলার দু'পাশে অবস্থিত ছোট গ্রন্থির মতো এই টনসিলের ভেতর অনেকগুলো সূক্ষ্ম খাঁজ বা গর্ত থাকে, যাকে বলা হয় টনসিল ক্রিপ্ট। এখানে খাবারের কণা, মৃত কোষ, ব্যাকটেরিয়া এবং লালা জমতে জমতে ছোট দানার মতো শক্ত হয়ে যায়। এই শক্ত দানাগুলোকেই বলা হয় টনসিল স্টোন।
এগুলো মূলত -
◑ সাদা, ক্রিম রঙের বা হলদেটে
◑ আকারে ক্ষুদ্র, অনেকটা চাল বা দানা সমান
◑ চাপ দিলে একটু শক্ত মনে হয়
◑ অনেক সময় দুর্গন্ধযুক্ত
টনসিল স্টোন সাধারণত ক্ষতিকর নয়, তবে উপসর্গ ও অস্বস্তি বেশ তৈরি করে।
কেন টনসিল স্টোন তৈরি হয়?
টনসিল স্টোন তৈরি হওয়ার প্রধান কয়েকটি প্রাকৃতিক কারণ রয়েছে। এগুলো বোঝা গেলে সমস্যা কমানো সহজ হয়।
১) টনসিলের খাঁজ গভীর হলে দলা জমার সম্ভাবনা বেশি। যাদের টনসিলের ভাঁজ বা খাঁজ (ক্রিপ্ট) স্বাভাবিকের তুলনায় গভীর, তাদের ক্ষেত্রে খাবারের কণা বেশি আটকে থাকে। ফলে জমে থাকা উপাদান ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে মিশে দানা তৈরি করে।
২) মুখের ভেতরে ব্যাকটেরিয়ার আধিক্য: মুখে প্রতিদিন অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া জন্মায় এবং এটাই স্বাভাবিক। তবে পরিষ্কার রাখা না হলে এই ব্যাকটেরিয়াগুলো টনসিলের ভেতর জমে থাকা উপাদানের সঙ্গে বিক্রিয়া করে দানাগুলো আরও দ্রুত শক্ত করে।
৩) দীর্ঘস্থায়ী টনসিল প্রদাহ (Tonsillitis history): যাদের বারবার টনসিল ফুলে যায়, তাদের ক্ষেত্রে টিস্যু পরিবর্তিত হতে পারে। এর ফলে ক্রিপ্ট আরও বেশি গভীর হয়ে যায় এবং দানা জমা সহজ হয়।
৪) শুষ্ক মুখ বা লালা কম উৎপাদন- লালা না থাকলে মুখের ব্যাকটেরিয়া জমে থাকতে শুরু করে। এতে দলা শক্ত হওয়ার গতি বাড়ে। মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়া, কম পানি পান, কিছু ওষুধের প্রভাব, ঘুমের সময় মুখ খোলা থাকার কারণে শুষ্ক মুখে তৈরি হতে পারে।
৫) দুর্বল ওরাল হাইজিন- যথাযথভাবে দাঁত পরিষ্কার না করা, মুখ ধোয়া না করা বা জিহ্বায় জমা ব্যাকটেরিয়া পরিষ্কার না করা—এগুলো টনসিল স্টোন তৈরি হওয়ার সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে।
টনসিল স্টোন কি বিপজ্জনক?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টনসিল স্টোন বিপদজনক নয়। তবে সমস্যা বাড়লে কিংবা অতিরিক্ত বড় হলে গলার প্রদাহ পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত গলা ব্যথা, গিলতে কষ্ট, দুর্গন্ধ, কানে ব্যথার অনুভূতি (রেফার্ড পেইন), গলার ভেতরে কিছু আটকে থাকার অনুভূতি ইত্যাদি ঝুঁকি দেখা যায়। বিরল ক্ষেত্রে বড় টনসিল স্টোন সংক্রমণ ডেকে আনতে পারে, যা চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা বাড়ায়।
সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গগুলো
১) মুখে দুর্গন্ধ (Halitosis), টনসিল স্টোনের সবচেয়ে চেনা লক্ষণ। ব্যাকটেরিয়া জমে ছাড়ে সালফারের মতো গন্ধ, যা নিঃশ্বাসে ভারী দুর্গন্ধ তৈরি করে।
২) গলায় কিছু আটকে থাকার অনুভূতি। যদিও দানাগুলো ছোট, তবু টনসিলের কোণে আটকে থাকলে বিরক্তিকর অনুভূতি হয়।
৩) গলা খুসখুস করা, কফ কাশতে কষ্ট। দলা জমলে গলার ভেতর খড়ের মতো অনুভূতি তৈরি হতে পারে।
৪) কানে ছড়ানো ব্যথা। টনসিল ও কানের নার্ভ সংযুক্ত। ফলে টনসিলে চাপ থাকলে ব্যথা কানে ছড়াতে পারে।
৫) গলা লাল ও ফোলা। বিরল ক্ষেত্রে দানা বড় হলে সামান্য প্রদাহ দেখা দিতে পারে।
টনসিল স্টোন কি নিজে নিজে বের হয়ে আসে?
হ্যাঁ, অনেক সময় কাশির সাথে বা পানি পান করার সময় নিজের থেকেই আলগা হয়ে বের হয়ে আসে। তবে এটি পুরোপুরি নির্ভর করে টনসিলের ক্রিপ্ট কত গভীর এবং দানার আকার কেমন তার ওপর।
টনসিল স্টোন তৈরির পিছনে দৈনন্দিন অভ্যাস, যা আমরা খেয়াল করি না-
☞ মুখ শুকনো রাখা। যারা সারাদিন পানি কম পান করেন বা বেশি সময় ঘরে AC-তে থাকেন, তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা বাড়ে।
☞ মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়া। নাক বন্ধ থাকলে দীর্ঘদিন মুখ দিয়ে শ্বাস নিলে মুখের ভেতর অতিরিক্ত শুষ্কতা তৈরি হয়।
☞ রাতের খাবারের পর মুখ না ধোয়া। রাতে ব্যাকটেরিয়া দ্রুত বেড়ে ওঠে।
☞ মিষ্টি, স্টিকি খাবার বেশি খাওয়া। এগুলো টনসিলের ভাঁজে বেশি আটকে থাকে।
টনসিল স্টোন প্রতিরোধে কার্যকর কিছু অভ্যাস-
এই অভ্যাসগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে সহায়ক এবং দৈনন্দিন জীবনে খুব বাস্তবসম্মত—
১) প্রতিদিন সঠিকভাবে দাঁত ও জিহ্বা পরিষ্কার করা:
⇨ দাঁতের ফাঁক পরিষ্কার রাখা
⇨ জিহ্বা স্ক্র্যাপার ব্যবহার
⇨ ঘুমানোর আগে ভালোভাবে ব্রাশ করা
এতে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ কমে যায়।
২) বেশি পানি পান করা: লালা মুখের ব্যাকটেরিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখে। পানি কম হলে দানা জমে ক্যালসিফাইড হওয়ার গতি বাড়ে।
৩) নাক দিয়ে শ্বাস নেওয়ার অভ্যাস: যাদের নাক বন্ধ থাকে, তাদের উচিত কারণ নির্ধারণ করে চিকিৎসা করানো।এটি দীর্ঘমেয়াদে টনসিল স্টোনের প্রবণতা কমায়।
৪) উষ্ণ লবণ পানি দিয়ে গার্গল: এটি শতবর্ষের সহজ পদ্ধতি। লবণ ব্যাকটেরিয়া কমায় এবং টনসিল ক্রিপ্টে জমে থাকা কণাগুলোকে আলগা করে।
৫) ধূমপান এড়ানো! ধোঁয়া মুখ শুকিয়ে যায়, লালার কাজ ব্যাহত হয়, যা টনসিল স্টোন বাড়াতে পারে।
কখন সতর্ক হতে হবে?
সাধারণত টনসিল স্টোন ক্ষতিকর নয়। কিন্তু কিছু লক্ষণে দ্রুত সন্ধান নেওয়া উচিত—
◑ টানা গলা ব্যথা বা জ্বর
◑ গিলতে স্থায়ী কষ্ট
◑ শ্বাস নিতে সমস্যা
◑ বারবার টনসিল ফুলে ওঠা
◑ দানা অত্যন্ত বড় হওয়া
◑ দুর্গন্ধ এত বেশি যে জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলছে
এসব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া নিরাপদ।
টনসিল স্টোন কি সারানো যায়?
স্টোন নিজে নিজে যেতে পারে, আবার দৈনন্দিন অভ্যাস বদলালেও অনেক সময় কমে যায়। যাদের বারবার হয়, তারা জীবনযাপন ও মুখের যত্ন পরিবর্তন করলে অনেক উপকার পান।
টনসিল স্টোন আকারে ক্ষুদ্র হলেও এর প্রভাব অনেক সময় গভীর হয়।দুর্গন্ধ, অস্বস্তি, গলার খুসখুস, কথা বলার সমস্যা সবই দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু ভালো খবর হলো, এটি এমন একটি সমস্যা যা অধিকাংশ সময়ে জীবনযাপনের অভ্যাস সামান্য পরিবর্তন করলেই কমে যায়। মুখ পরিষ্কার রাখা, পানি পান, নাক দিয়ে শ্বাস নেওয়া, লবণ পানির গার্গল এই সরল অভ্যাসগুলোই বছরের পর বছর টনসিল স্টোন প্রতিরোধে কাজ করে। টনসিল স্টোন কোনো অজানা বা রহস্যময় অসুখ নয়। এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ, যা সচেতনতায় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়লে অনেকেই গলার দীর্ঘস্থায়ী অস্বস্তির আসল কারণটি চিনতে পারবেন এবং দ্রুত সমাধান পাবেন।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।