মনোযোগ কেন আর স্থির থাকে না?-প্রযুক্তি ও মস্তিষ্ক একসঙ্গে দেখাচ্ছে চমকপ্রদ পথ!

মনোযোগ কেন আর স্থির থাকে না?-প্রযুক্তি ও মস্তিষ্ক একসঙ্গে দেখাচ্ছে চমকপ্রদ পথ!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

দুনিয়াটা বদলে গেছে। আর বদলের সবচেয়ে বড় অভিঘাত পড়েছে আমাদের মনোযোগের ওপর। হাজার নোটিফিকেশন, পরপর সিদ্ধান্ত, স্ক্রিনের আকর্ষণ, কাজের চাপ, তথ্যের সুনামি সব মিলিয়ে মানুষের মনোযোগ এখন সবচেয়ে দুর্লভ সম্পদ। গবেষকেরা বলেন, মনোযোগ এত দ্রুত খরচ হয়ে যায় যেন আধুনিক জীবনের ব্যস্ততার আগুনে গলে যাওয়া মোমবাতি। কিন্তু প্রশ্ন হলো আসলে মনোযোগ কমে কেন? এটি কি শুধুই অভ্যাসের সমস্যা, নাকি মস্তিষ্কের তথ্য প্রক্রিয়াকরণের সীমাবদ্ধতা? আর কি প্রযুক্তিই আবার এই সংকটের সমাধান দিতে পারে?

মনোযোগ আসলে একধরনের মস্তিষ্কীয় ফিল্টার, যা ঠিক করে কোন তথ্য গ্রহণ করতে হবে এবং কোনটি বাদ দিতে হবে। কিন্তু আধুনিক জীবনে এই ফিল্টারের ওপর চাপ এত বেশি যে মস্তিষ্ক দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

মনোযোগ হারানোর প্রধান কারণগুলো-

১) তথ্যের অতিরিক্ত চাপ (Information Overload): প্রতিদিন মানুষ আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বহু গুণ বেশি তথ্য গ্রহণ করছে। মস্তিষ্কের প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা সীমিত; অতিরিক্ত চাপ পড়লে মনোযোগ দ্রুত ভেঙে যায়।

২) নোটিফিকেশন-প্ররোচিত বিঘ্ন: ফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ এর প্রতিটি বার্তা একেকটি মনোযোগ-চুম্বক। এগুলো মস্তিষ্কের ডোপামিন সিস্টেমকে উদ্দীপ্ত করে, ফলে বারবার স্ক্রিন চেক করার অভ্যাস গড়ে ওঠে।

৩) মাল্টিটাস্কিংয়ের ভুল ধারণা: মানুষ ভাবে তারা একসঙ্গে অনেক কাজ করতে পারে। কিন্তু মস্তিষ্কের বাস্তবতা ভিন্ন। এক কাজ থেকে আরেক কাজে বারবার সুইচ করার ফলে মনোযোগের শক্তি ভেঙে যায়।

৪) মানসিক ক্লান্তি ও ঘুমের অভাব থাকা টেনশন, কম ঘুম, মানসিক ক্লান্তি সবই মনোযোগ কমার বড় কারণ।

৫) ডিজিটাল পরিবেশের দ্রুত উত্তেজনা: স্ক্রিনে দ্রুত পরিবর্তনশীল রঙ, শব্দ, নোটিফিকেশন সবই মস্তিষ্ককে ক্ষুদ্র সময়ের মনোযোগ -এর দিকে ঠেলে দেয়।

এই  কারণগুলো মিলেই আধুনিক মানুষ মনোযোগ ধরে রাখার লড়াইয়ে প্রায়ই পরাজিত হয়।
 

মনোবিজ্ঞান অনুযায়ী, মনোযোগ তিন ধরনের-

১) Sustained Attention: এক কাজে দীর্ঘ সময় ধরে মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা।

২) Selective Attention: শব্দ, গন্ধ, আলো বা চলমান বিঘ্ন বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় দিকে মনোযোগ দেওয়া।

৩) Executive Attention: কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মানসিক সম্পদ ব্যবহার করার ক্ষমতা।

আধুনিক পরিবেশে এই তিন ধরনের মনোযোগই চাপের মধ্যে পড়ে। কিন্তু কেন?

কারণ মস্তিষ্ক "রিওয়ার্ড" খোঁজে। স্ক্রিনের দ্রুত পরিবর্তন এত দ্রুত রিওয়ার্ড দেয় যে মস্তিষ্ক দীর্ঘ সময়ের মনোযোগকে কম আকর্ষণীয় মনে করে। অর্থাৎ—মনোযোগ কমে যাওয়া কোনো দুর্বলতা নয়, বরং আধুনিক পরিবেশে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।

 

অনেকে মনে করেন প্রযুক্তি শুধু মনোযোগ কমায়।আংশিক সত্য হলেও কিন্তু প্রযুক্তিই আবার মনোযোগ বাড়ানোর শক্তিশালী উপায়ও তৈরি করেছে।

প্রযুক্তির মনোযোগ-বর্ধক সমাধান তিনভাবে কাজ করে-

➤ Distraction Blocking, বিঘ্ন প্রতিরোধ-

◑ Focus Mode বা "Disturbance-Free" সিস্টেম: ডিভাইস নির্মাতারা এখন এমন মোড তৈরি করেছে যা নোটিফিকেশন বন্ধ করে, জরুরি অ্যাপ ছাড়া সব অ্যাপ লক করে, সময় নির্দিষ্ট করে মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে। এই মোডগুলো মস্তিষ্ককে মনোযোগ-স্থিতিশীল পরিবেশ দেয়।

◑ Website Blocker Tools: বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এমন টুল পাওয়া যায় যা কাজের সময় সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ রাখে, বিভ্রান্তিকর ওয়েবসাইট ব্লক করে এবং টাস্ক-নির্দিষ্ট পরিবেশ তৈরি করে। মনোবিজ্ঞানে এটি "External Control of Focus Stimuli" হিসেবে পরিচিত।
 

➤ Cognitive Training Tools, মস্তিষ্কের মনোযোগের পেশি শক্তিশালী করা-

কগনিটিভ ট্রেনিং অ্যাপগুলো যে কাজ করে-

◑ স্বল্প সময়ের মনোযোগ বাড়ানো

◑ তথ্য প্রক্রিয়াকরণ দ্রুত করা

◑ কাজের প্রতি একাগ্রতা উন্নত করা

◑ স্মৃতিশক্তি বাড়ানো

◑ মানসিক সহনশীলতা বৃদ্ধি করা

এগুলো এমন গেম বা টাস্ক ব্যবহার করে যা মস্তিষ্কের মনোযোগ-সংশ্লিষ্ট অংশকে সক্রিয় রাখে। এটি ধীরে ধীরে মস্তিষ্ককে দীর্ঘ সময়ের মনোযোগে অভ্যস্ত করে।
 

➤ Neurofeedback Tools, মনোযোগের মানসিক অবস্থা শনাক্ত করে সহায়তা-

এ ধরনের প্রযুক্তিতে মস্তিষ্কের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করে বোঝা হয়— কখন মনোযোগ ভাঙছে, কখন ক্লান্তি বাড়ছে, কখন উত্তেজনা কমছে, কখন বিশ্রাম প্রয়োজন। এই তথ্যের ভিত্তিতে ব্যবহারকারীকে সতর্ক করা হয়, যাতে তারা মনোযোগ ধরে রাখতে পারে। এটি মনোবিজ্ঞানের "Self-regulated Attention Control"-কে আরও উন্নত করে।
 

প্রযুক্তির পাশাপাশি মনোবিজ্ঞান মনোযোগ বাড়ানোর কিছু নিয়মিত, বাস্তবসম্মত উপায় নির্দেশ করে-

১) Pomodoro Technique, সময়ভিত্তিক মনোযোগ-চক্র: ২৫ মিনিট মনোযোগ + ৫ মিনিট বিরতি মস্তিষ্ক মনে করে—"তাৎক্ষণিক চাপ নেই"। ফলে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে।

২) Deep Work Strategy: দিনের নির্দিষ্ট সময় স্ক্রিন-মুক্ত, বিঘ্ন-মুক্ত কাজের পরিবেশ তৈরি করা। এটি মস্তিষ্কের সাসটেইন্ড অ্যাটেনশন বাড়ায়।

৩) Mindfulness Practices : শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, দেহ-মন পর্যবেক্ষণ মনের বিচিত্র চিন্তার ওপর নিয়ন্ত্রণ। এই প্রক্রিয়া মনোযোগকে ভেতর থেকে প্রশিক্ষণ দেয়।

৪) Monotasking Habit : একবারে একাধিক কাজ নয়, একটি কাজ করুন  । এটি cognitive overload কমায়।

৫) Sleep & Rest Regulations : ঘুমেই মস্তিষ্ক তার মনোযোগ ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করে।
ঘুম কম হলে মনোযোগ ভেঙে যাওয়া সবচেয়ে স্বাভাবিক ঘটনা।

মস্তিষ্ক প্রতিদিন বিপুল শক্তি ব্যয় করে। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ খরচ হয় মনোযোগ ধরে রাখতে। যখন মস্তিষ্ক অতিরিক্ত বিভ্রান্তির মুখে পড়ে তখন নিউরন ক্লান্ত হয়, শক্তি কমে যায়, মনোযোগ হঠাৎ ভেঙে পড়ে। এটি স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এ কারণেই অল্প বিরতি নেওয়াও মনোযোগ বাড়ায়।

 

আধুনিক সমাধানের নতুন মডেল হলো-
"Hybrid Attention System"। যেখানে প্রযুক্তি তৈরি করে মনোযোগের পরিবেশ
আর মনোবিজ্ঞান শেখায় মনোযোগ ধরে রাখার দক্ষতা। এই দুইয়ের মিলনেই তৈরি হয়েছে-

১) স্মার্ট ফোকাস অ্যাপ, যা বিভ্রান্তি বন্ধ করার পাশাপাশি মস্তিষ্কের গতিশীলতার বিশ্লেষণ দেখায়।

২) Work Management Systems, যেখানে— কাজ ভেঙে ভাগ করা, সময় নির্ধারণ, বিশ্রাম স্লট দেওয়া, বিঘ্ন ব্লক করা সব থাকে একসঙ্গে।

৩) AI-driven Attention Tools, যা ব্যবহারকারীর অভ্যাস বুঝে— কোন সময়ে মনোযোগ ভালো থাকে
 

কখন কমে যায়, কোন ধরণের কাজের প্রতি একাগ্রতা বেশি, কোন অ্যাপ বিভ্রান্তির উৎস
এসব বিশ্লেষণ করে ব্যক্তিগত ফোকাস-পরিকল্পনা তৈরি করে।
 

চ্যালেঞ্জ:

আধুনিক কাজের জায়গায় মনোযোগ কমে যাওয়ার প্রভাব-

◑ দক্ষতা কমে যায়

◑ ভুল বাড়ে

◑ মানসিক চাপ বাড়ে

◑ সৃজনশীলতা ঘাটতি দেখা দেয়

 

এতে অনেকেই "ডিজিটাল ক্লান্তি"-তে ভুগে। সংগঠনগুলো তাই এখন ফোকাস-ফ্রেন্ডলি পরিবেশ তৈরি করতে গুরুত্ব দিচ্ছে—

◑ নোটিফিকেশন-মুক্ত মিটিং

◑ নির্দিষ্ট মনোযোগঘন্টা

◑ ইমেইল-প্রেশার কমানো

◑ স্ক্রিন বিরতি

◑ সুস্থ মানসিক পরিবেশ

এগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে মনোযোগ বাড়ায়।
 

আগামী দিনের Focus Enhancement প্রযুক্তি আরও এগিয়ে যাচ্ছে-

১) Emotion-sensing ওএয়ারাব্লেস- 

যা মনোযোগ ভাঙার আগে ব্যবহারকারীকে সতর্ক করবে।

২) পরিবেশ পরিবর্তনকারী AI সিস্টেম- আলোর তীব্রতা থেকে শুরু করে চারপাশের শব্দ-
সবই AI নিয়ন্ত্রণ করবে মনোযোগের সুবিধা অনুযায়ী।

৩) মস্তিষ্ক-সংকেত বিশ্লেষণ করে কাস্টম ফোকাস প্রোফাইল। এগুলি মানুষভেদে আলাদা মনোযোগ-পরিবেশ তৈরি করবে।

৪) ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ভিত্তিক "ডিসট্র্যাকশন-মুক্ত" রুম- যেখানে পুরো ডিজিটাল পরিবেশ মনোযোগ বাড়ানোর মতো করে সাজানো হবে।

 

ফোকাস Enhancement এখন আর কেবল ব্যক্তিগত অভ্যাসের বিষয় নয়—
এটি যুগের চাহিদা। আজকের ক্রমাগত বিঘ্ন-ভারাক্রান্ত জীবনে মনোযোগ ধরে রাখা যেন নদীর ধারা আঁকড়ে রাখার মতো কঠিন। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে সমাধান আছে, এবং সেটি প্রযুক্তি ও মনোবিজ্ঞানের যৌথ প্রচেষ্টায় তৈরি হচ্ছে। মনোযোগ হারানো এখন আর অপরিহার্য দুর্বলতা নয় বরং সচেতন ব্যবস্থাপনা ও সঠিক সরঞ্জাম ব্যবহারে এটি এক শক্তিশালী দক্ষতায় রূপ নিতে পারে। যারা মনোযোগ বাড়াতে পারে, তাদের মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণ আরও স্পষ্ট হয়, সৃজনশীলতা তীক্ষ্ণ হয় আর কাজের ফলাফল বেড়ে যায় বহুগুণে। ফোকাস Enhancement তাই কেবল দক্ষতা-উন্নয়ন নয়, এটি মানুষের মানসিক সুস্থতা, উৎপাদনশীলতা ও আধুনিক জীবনের ভারসাম্য রক্ষার নতুন দিশা।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ