তরুণদের মধ্যে বাড়ছে রেক্টাল ক্যানসার! লক্ষণ শুরুতেই চিনুন, সতর্ক থাকুন এখনই!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
একসময় ক্যানসারকে অনেকেই ভাবতেন বয়সের রোগ, বিশেষত কোলোরেক্টাল বা রেক্টাল ক্যানসার। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যে প্রবণতা লক্ষ্য করছেন তা উদ্বেগজনক এবং একই সঙ্গে নতুন বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে আমাদের। দেখা যাচ্ছে, ৩০–৪৫ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে রেক্টাল ক্যানসারের হার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু তাই নয় অনেক ক্ষেত্রেই রোগ ধরা পড়ছে উন্নত পর্যায়ে, যখন চিকিৎসা তুলনামূলক জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদী।রেক্টাল ক্যানসার হাতের তালুর মতো স্পষ্ট কোনো লক্ষণ দিয়ে শুরু হয় না; বরং খুব নীরবভাবে এগিয়ে যায়, আর এ কারণেই ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। তরুণদের জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস, প্রযুক্তিনির্ভরতা, অনিয়মিত ঘুমের ধরণ, দ্রুতগতির জীবন সবকিছু মিলেই অজান্তে শরীরে তৈরি করছে প্রদাহ ও কোষগত পরিবর্তন, যা ভবিষ্যতে ক্যানসারের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে তুলতে পারে। রেক্টাল ক্যানসার বৃদ্ধির পেছনে কোনো একক কারণ নেই; বরং রয়েছে বহুস্তরীয় প্রভাব।
☞ অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ করা! প্রতিদিনের খাবারে অতিরিক্ত প্রসেসড মাংস, লাল মাংস, ফাস্ট ফুড, ডিপ-ফ্রাইড খাবার ও উচ্চ লবণ–চিনি–চর্বিযুক্ত খাবারের আধিক্য শরীরে দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ সৃষ্টি করে। এই প্রদাহ কোলন ও রেক্টামের কোষকে ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত করে।
☞ ফাইবার কম থাকা খাদ্যাভ্যাস!
ফাইবার কম খেলে:
◑ মল নরম থাকে না
◑ দীর্ঘ সময় রেক্টামে চাপ সৃষ্টি হয়
◑ কোষের ওপর ক্রমাগত ঘর্ষণে DNA ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ে
◑ ফাইবার অন্ত্র পরিষ্কার রাখতে ও ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য বজায় রাখতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
☞ দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা 'সাইলেন্ট ট্রিগার'!
ডেস্ক–জব, অনলাইন ক্লাস, গেমিং—তরুণদের মধ্যে বসে থাকার সময় বেড়েই চলেছে। এতে রক্ত সঞ্চালন কমে, রেক্টাল টিস্যুতে অক্সিজেন সরবরাহ কমে, কোষে অস্বাভাবিক পরিবর্তন শুরু হতে পারে।
☞ স্থূলতা ও হরমোনাল পরিবর্তন-
অতিরিক্ত ওজন শরীরে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স তৈরি করে, যা ক্যানসার বৃদ্ধির অন্যতম জৈবিক উপায়। উচ্চ চর্বিযুক্ত শরীর থেকে নিঃসৃত হরমোনও টিস্যুতে অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকে উস্কে দিতে পারে।
☞ অ্যালকোহল ও ধূমপান- উভয়ই রেক্টাল কোষের DNA পরিবর্তন ঘটাতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তরুণদের মধ্যে অ্যালকোহল গ্রহণ বেড়ে যাওয়াও গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
☞ অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট হওয়া- ব্যস্ত জীবন, অনিয়মিত খাবার, প্রসেসড খাদ্য সব মিলে অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম বদলে যায়। এই পরিবর্তন দীর্ঘমেয়াদে মিউকোসাল লাইনিং দুর্বল করে, যা ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
কোন কোন সংকেত আগেই বুঝবেন?- প্রাথমিক লক্ষণ
রেক্টাল ক্যানসারের লক্ষণ অনেক সময় হালকা এবং অগোচরে থাকে। কিন্তু শরীর কিছু সংকেত দেয়—যেগুলোকে কখনোই হালকা ভাবে নেওয়া উচিত নয়।
১. মলে রক্ত (Blood in Stool): অনেকে piles ভেবে উপেক্ষা করেন- এটাই সবচেয়ে বড় ভুল। রক্তের রং দেখা জরুরি-
◑ উজ্জ্বল লাল রক্ত সাধারণত রেক্টাল অঞ্চলের সংকেত।
◑ গাঢ় বা কালচে রক্ত কোলনের আরও উপরের অংশে সমস্যা নির্দেশ করতে পারে।
২. দীর্ঘমেয়াদি কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া: অন্ত্রের স্বাভাবিক গতি নষ্ট হলে তা কোলন বা রেক্টামে কোনো বাধা বা টিস্যুর পরিবর্তন নির্দেশ করতে পারে।
৩. মলত্যাগের পরও পেট সম্পূর্ণ খালি না লাগা:এটা রেক্টালের অভ্যন্তরে কোনো গ্রোথ বা টিউমারের কারণে হতে পারে।
৪. পেট ফাঁপা, তলপেট ভারী লাগা: নিয়মিত হলে সতর্ক হওয়া জরুরি।
৫. শরীরে দুর্বলতা বা অল্প হাঁটলেই ক্লান্তি: শরীরে আয়রন কমে গেলে এমন হয়। মনে রাখতে হবে, লুকিয়ে রক্তক্ষরণ ক্যানসারের সাধারণ লক্ষণ।
৬. অল্প সময়ে ওজন কমে যাওয়া: খাওয়া–দাওয়া ঠিক থাকা সত্ত্বেও ওজন কমার পেছনে কোষগত অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে।
৭. মলত্যাগে ব্যথা: টিস্যুতে প্রদাহ বা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এমন ব্যথার কারণ হতে পারে।
এগুলোর একটি দেখা দিলেই ক্যানসার মানে নয়। কিন্তু ক্রমাগত চলতে থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অপরিহার্য।
রেক্টাল ক্যানসার কীভাবে শুরু হয়?
মানবদেহে কোষ স্বাভাবিকভাবে বিভাজন করে। কোনো সময় কোষের DNA ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেই কোষ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে শুরু করে। এই অস্বাভাবিক কোষ প্রথমে ছোট পলিপ হিসেবে জন্মায়, যা ধীরে ধীরে বড় হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ে ক্যানসার রূপ নিতে পারে। রেক্টাল অঞ্চলে পলিপ জন্মানোর কারণ:
⇨ জেনেটিক প্রবণতা
⇨ দীর্ঘদিনের প্রদাহ
⇨ অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
⇨ টক্সিন এক্সপোজার
⇨ ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্যহীনতা
আশ্চর্যের বিষয়, পলিপ তৈরি হতে ৫–১০ বছর সময় লাগে। অর্থাৎ নিয়মিত চেকআপ করলে খুব আগেই শনাক্ত করা যায় এবং ক্যানসার হওয়ার আগেই অপসারণ করা সম্ভব।
তরুণদের কেন দেরিতে ধরা পড়ে?
১. তারা মনে করেন "আমার বয়স কম, কিছু হবে না"। ফলে হালকা উপসর্গকেও উপেক্ষা করা হয়।
২. লজ্জা বা সংকোচ! মল, পায়ুপথ বা রেক্টাল সমস্যা নিয়ে কথা বলতে অনেকেই নার্ভাস।
৩. চিকিৎসা নিতে দেরি করে। ফলে রোগ ধরা পড়ে অনেক পরে।
৪. প্রাথমিক স্ক্রিনিং কম করা হয়। তরুণরা অন্ত্রের স্বাস্থ্যের গুরুত্ব অনুধাবন করেন না।
কিভাবে নির্ণয় করা হয়?—চিকিৎসাবিজ্ঞানের বাস্তব ধাপ
রেক্টাল ক্যানসারের নির্ণয়ের জন্য সাধারণত যেসব পরীক্ষা করা হয়:
☞ Stool Occult Blood Test (গোপন রক্ত)
☞ Sigmoidoscopy (রেক্টাম ও নিচের কোলন দেখা)
☞ Colonoscopy
☞ CT Scan / MRI
☞ Biopsy (টিস্যুর কোষ বিশ্লেষণ)
এগুলো ক্যানসারের পর্যায়, বিস্তার ও চিকিৎসা পরিকল্পনা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
চিকিৎসা-
রেক্টাল ক্যানসারের চিকিৎসা নির্ভর করে:
◑ ক্যানসারের পর্যায়
◑ টিউমারের অবস্থান
◑ বয়স এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের ওপর
◑ চিকিৎসা সাধারণত তিন ধরনের সমন্বয়ে করা হয়:
সার্জারি-
☞ রেডিয়েশন থেরাপি
☞ কেমোথেরাপি
আধুনিক চিকিৎসায় অনেক ক্ষেত্রে কম আক্রমণাত্মক পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে, যাতে রোগীদের দ্রুত সুস্থ করা যায়।
কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবেন?
১. প্রতিদিন ফাইবার–সমৃদ্ধ খাবার খান।যেমন—শাক–সবজি, ফল, ওটস, ডাল, ব্রাউন রাইস। ফাইবার অন্ত্র পরিষ্কার রাখে এবং টিউমারের ঝুঁকি কমায়।
২. প্রসেসড মাংস কমান। বারবার খেলে কোলন–রেক্টাল কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
৩. নিয়মিত ব্যায়াম করুন। এতে রক্তসঞ্চালন বাড়ে, শরীরের প্রদাহ কমে।
৪. ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন। স্থূলতা রেক্টাল ক্যানসারের অন্যতম বড় ঝুঁকি।
৫. ধূমপান–অ্যালকোহল পরিহার করুন। কোষের DNA রক্ষা করতে সাহায্য করে।
৬. পর্যাপ্ত পানি পান করুন। অন্ত্রের সুষ্ঠু কার্যক্রমে পানি অপরিহার্য।
৭. নিয়মিত চেকআপ করানো উত্তম। বিশেষ করে পরিবারের কারো রেক্টাল/কোলন ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে।
তরুণদের জন্য বিশেষ সতর্কতা
◑ দীর্ঘদিন কোষ্ঠকাঠিন্য?
◑ মলে অল্প রক্ত দেখা যাচ্ছে?
◑ পেট ব্যথা, ফাঁপা ভাব নিয়মিত?
এসবকে 'এড়ানো যায় এমন সমস্যা' মনে করবেন না। এগুলো শরীরের সতর্ক সংকেত। ক্যানসার প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে চিকিৎসার সাফল্য ৯০%–এর কাছাকাছি।
রেক্টাল ক্যানসার তরুণদের মধ্যে বাড়ছে। এটি কোনো আতঙ্ক ছড়ানোর খবর নয়, বরং বাস্তবতা। এই ক্যানসার অনেকটাই প্রতিরোধযোগ্য, এবং প্রথমদিকে শনাক্ত হলে চিকিৎসা খুব কার্যকর।যৌবনের ব্যস্ততা, দ্রুতগতির জীবন, অনিয়মিত খাবার সব মিলেই আমরা শরীরের প্রতি আগের মতো মনোযোগ দিচ্ছি না। কিন্তু শরীর আমাদের সঙ্গে কথা বলে- কখনো ব্যথায়, কখনো অস্বস্তিতে, কখনো অন্য কোনো পরিবর্তনে। সেই ভাষা ঠিকমতো বুঝতে পারা মানেই আমরা নিজেদের বাঁচানোর পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। তাই লক্ষণ শুরুর আগেই সচেতন হোন, আর শরীরের ছোট সংকেতগুলো উপেক্ষা করবেন না। স্বাস্থ্যই সামনে এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।