আপনি কি ইতিমধ্যেই আক্রান্ত?-সেলফ ডাউটের ছায়া এবং তার ঝুঁকি আজই যাচাই করুন
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
জীবনের প্রতিটি বাঁকে, সিদ্ধান্তের প্রতিটি মুহূর্তে, স্বপ্নকে ধরার প্রতিটি চেষ্টায় একটা অদৃশ্য শক্তি নীরবে আমাদের থামিয়ে দেয়। সেই শক্তির নাম সেলফ ডাউট (Self-Doubt), বা আত্মসন্দেহ। বড় অসুখগুলো আমরা সহজেই বুঝতে পারি।জ্বর হলে শরীর গরম হয়, ঘা হলে ব্যথা অনুভব করি। কিন্তু সেলফ ডাউট হলো এমন এক নীরব মানসিক ক্ষয়, যা মানুষ বছরের পর বছর বয়ে বেড়ায় কোনো শব্দ ছাড়াই, কোনো চিহ্ন ছাড়াই। মনোবিজ্ঞানীরা একে “মনের ক্যান্সার” বলে থাকেন। কারণ এটি ধীরে ধীরে আপনার আত্মবিশ্বাস, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, সৃজনশীলতা, ব্যক্তিত্ব, এমনকি ভবিষ্যৎ পর্যন্ত গ্রাস করে।আর ভয়াবহ সত্য হলো, অধিকাংশ মানুষ বুঝতেই পারেন না, তাঁরা ইতোমধ্যেই এতে আক্রান্ত।
আত্মসন্দেহ হলো এমন একটি মানসিক প্রবণতা যেখানে মানুষ নিজের ক্ষমতা, দক্ষতা, সিদ্ধান্ত, মূল্য-সবকিছুকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যেমন-
“আমি হয়তো পারব না…”
“ওরা যদি হাসে!”
“আমার সিদ্ধান্ত ঠিক হলো তো!”
“আমি কি যথেষ্ট ভালো!”
“ভুল হয়ে গেলে!”
এই প্রশ্নগুলো আমাদের মনে প্রায় অদৃশ্যভাবে জন্মায়। কিন্তু যত বাড়তে থাকে, ততই আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রকে গ্রাস করতে থাকে।সেলফ ডাউট এমন এক মানসিক দানব, যা আপনার ভিতরের আলোকে নিভিয়ে দেয় ধীরে ধীরে।
এটিকে “মনের ক্যান্সার” বলা হয়। কারণ:
১) এটি নীরবে ছড়িয়ে পড়ে। আপনি অনুভবও করেন না কবে এটি আপনার ভাবনা, কাজ, সম্পর্ক—সবকিছুকে দখল করে নেয়।
২) জীবনে উন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়। সেলফ ডাউট থাকা মানুষ সুযোগ পেলেও হাত বাড়াতে পারে না।
নিজের যোগ্যতাকে ছোট করে দেখে।
৩) সৃজনশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। মনের ভিতর ভয় ছড়িয়ে পড়ে। এই ভয় সৃজনশীল কাজকে গলা টিপে ধরে।
৪) আত্মবিশ্বাস ভেঙে যায়। একবার সন্দেহ শুরু হলে তা ব্যক্তিত্বের প্রতিটি স্তরকে দুর্বল করে।
৫) দীর্ঘমেয়াদে এটি মানসিক অস্থিরতা তৈরি করে। চাপ, উদ্বেগ, ঘুমের সমস্যা, সিদ্ধান্তহীনতা-সবই বাড়তে থাকে।
সেলফ ডাউট আসলে কেন জন্মায়?
মানব–মস্তিষ্কে একটি স্বাভাবিক প্রবণতা আছে- নিরাপদ থাকার জন্য কোনো ঝুঁকি এড়িয়ে চলা। নতুন কিছু করতে গেলে মস্তিষ্ক বিপদের সঙ্কেত তৈরি করে। যদি সেই সঙ্কেত বারবার কার্যকর হয়, তা সেলফ ডাউট-এ রূপ নেয়। মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় সেলফ ডাউট-এর কিছু প্রধান উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে-
১) শৈশবের অভিজ্ঞতা- পরিবারে অতিরিক্ত সমালোচনা, তুলনা, অপমান এসব শিশুর মনে এক গভীর ক্ষত রেখে যায়, যা বড় বয়সে আত্মসন্দেহে রূপ নেয়।
২) সমাজের প্রত্যাশা- বাংলার সমাজে “ফার্স্ট হতে হবে”, “মানুষ কী বলবে”-
এই চাপ সেলফ ডাউট-এর প্রধান উপাদান।
৩) ব্যর্থতার ভয়- একবার ব্যর্থ হলে মানুষ মনে করে-
“আবার ব্যর্থ হব।”
ব্যর্থতার স্মৃতি আত্মবিশ্বাসের শত্রু।
৪) অন্যদের সাথে তুলনা- সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তুলনা একটি দৈনন্দিন মানসিক রোগ। এতে মানুষ ভাবে-“ওরা এত ভালো করছে, আমি কেন পারছি না?”
৫) পরিপূর্ণতার চাপ- যারা সবসময় নিখুঁত হতে চান, তারা সবচেয়ে বেশি Self-Doubt-এ ভোগেন।
৬) অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা- মস্তিষ্ক যত বেশি চিন্তা করে, তত বেশি সন্দেহ তৈরি হয়।
সেলফ ডাউট সবচেয়ে বেশি কোন মানুষকে আক্রমণ করে?
গবেষণায় দেখা যায়, এটি এমন মানুষদের বেশি আঘাত করে—
◑ যারা সংবেদনশীল
◑ যারা নিজেকে খুব বেশি চাপ দেয়
◑ যারা সবার ভালো রাখতে চায়
◑ যারা শৈশবে তুলনার শিকার
◑ যারা ব্যর্থতাকে ভয় পায়
◑ যারা সামাজিক প্রত্যাশা পূরণে চেষ্টা করে
এমনকি আত্মবিশ্বাসী, সফল মানুষও সেলফ ডাউট–এ আক্রান্ত হতে পারে। কারণ মানুষ যত উপরে ওঠে, ততই ভয় পায় - সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারব কি না!!
সেলফ ডাউট সবসময় কি খারাপ?
মানুষ জীবনে মাঝে মাঝে নিজের সীমা যাচাই করার জন্য সামান্য আত্মসন্দেহ ভালো। কিন্তু যখন এটি অভ্যাস হয়ে যায়, চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে, সিদ্ধান্তকেও পঙ্গু করে ফেলে , আমাদের স্বপ্নকে আটকে রাখে তখনই এটি রোগে পরিণত হয়।
সেলফ ডাউট–এর লক্ষণ-
এটি ধরার জন্য ১০টি সূচক ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি লক্ষণ আপনি যত বেশি অনুভব করেন, সেলফ ডাউট তত বেশি আপনার ভেতরে-
১) সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাওয়া। ছোট সিদ্ধান্তও নিতে ঘন্টার পর ঘন্টা ভাবেন!
২) সবসময় ‘ভুল হওয়ার’ ভয়। কাজের শুরুতেই মনে হয়-“আমি পারব না”।
৩) নিজের অর্জনকে ছোট করে দেখা। আপনি ভালো কিছু করলেও মনে হয়-“এটা তেমন কিছু না।”
৪) অন্যদের মতামতের ওপর নির্ভরতা। নিজের বিচার বাদ দিয়ে সবসময় অন্যকে জিজ্ঞেস করেন!
৫) মানুষের ‘হাসি’ বা ‘সমালোচনার’ ভয় মনে হয়-“ওরা আমাকে বিচার করবে।”
৬) সুযোগ পেলেও এগোতে ভয়। নতুন কাজ, পদোন্নতি, সম্পর্ক, যেকোনো আগ্রগতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন।
৭) স্থায়ী অস্থিরতা। মনে একটা চেপে থাকা অনুভূতি কাজ করে।
৮) নিজেকে কম মূল্যবান মনে করা। মনে হয়-‘আমি যথেষ্ট নই’।
৯) সাফল্যের মাঝেও সন্দেহ। কিছু অর্জন করলেও মনে হয়-“এটা হয়তো ভাগ্য।”
১০) অতিরিক্ত চিন্তা করা। ঘটনার আগেই ভবিষ্যতের ৫০টি ভয় কল্পনা করেন।
এই লক্ষণগুলোর মধ্যে ৬টির বেশি আপনার মধ্যে মিলে গেলে- সেলফ ডাউট ইতোমধ্যেই আপনাকে প্রভাবিত করছে।
শরীর ও মনের ওপর প্রভাব:
➤ অতিরিক্ত Self-Doubt
◑ হৃদস্পন্দন বাড়ায়
◑ কর্টিসল হরমোন বাড়িয়ে স্ট্রেস তৈরি করে
◑ ঘুমে সমস্যা করে
◑ মেমোরি দুর্বল করে
◑ কাজের মনোযোগ কমায়
◑ উদ্বেগ সৃষ্টি করে
◑ ক্লান্তি তৈরি করে
দীর্ঘমেয়াদে এটি ব্যক্তির জীবনমানকে ভয়াবহভাবে ক্ষয় করে দেয়।
মুক্তির কৌশল-
১) “প্রমাণ” খুঁজুন। যখন মনে হয়-“আমি পারব না”, তখন নিজেকে জিজ্ঞেস করুন- “এ কথার সত্যি প্রমাণ কোথায়?” বেশিরভাগ সময়ই প্রমাণ থাকে না।
২) নিজেকে ছোট করে দেখবেন না। আপনার অর্জন লিখে রাখুন। মস্তিষ্ক বাস্তব তথ্য দেখলে ভীতি কমে।
৩) ভুল করার ভয়কে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করুন। মানুষ ভুল করেই শেখে। এ ধারণা আত্মসন্দেহকে দুর্বল করে।
৪) নিজের মতামতকে মূল্য দিন। অন্যের ওপর নির্ভর না করে প্রথমে নিজের সিদ্ধান্ত নিন।
৫) তুলনা কমান। আপনার জীবন আপনার। তুলনা মানসিক বিষ।
৬) নিজের অপূর্ণতাকে গ্রহণ করুন। পরিপূর্ণতা এক ধরনের চাপ- এটি যত কমবে, সন্দেহও তত কমবে।
৭) সমর্থন খুঁজুন। আপনার কথা কেউ শুনুক, এটাই বড় থেরাপি।
৫ মিনিটের Self-Doubt টেস্ট (নিজেই করুন)-
নিচের প্রতিটি প্রশ্নে “হ্যাঁ” হলে ১ পয়েন্ট:
১. গুরুত্বপূর্ণ কাজের আগে ভয় লাগে?
২. সিদ্ধান্ত নিতে বারবার পিছিয়ে যান?
৩. নিজেকে যোগ্য মনে হয় না?
৪. অন্যের সাফল্য দেখলে নিজেকে তুলনা করেন?
৫. সুযোগ পেলেও এগোতে ভয় পান?
৬. কাজে ভুল হলে নিজেকে দোষ দেন?
৭. প্রশংসা পেলে অস্বস্তি লাগে?
৮. সবসময় মনে হয়—“আরও ভালো করতে পারতাম”?
স্কোর যদি ৬–৮ হয়ে থাকে তবে আপনি উচ্চ সেলফ ডাউট পর্যায় আছেন। যদি স্কোর ৪–৫ হয়ে থাকে তবে মাঝারি সেলফ ডাউট, আর যদি স্কোর ০–৩ হলে নিয়ন্ত্রণে আছে।
সেলফ ডাউট কোনো ছোট সমস্যা নয়।এটি আস্তে আস্তে আপনার স্বপ্ন, সৃজনশীলতা, সিদ্ধান্ত, আত্মসম্মান সবকিছুকে নীরবে গ্রাস করে। মানুষ বাইরে থেকে স্বাভাবিক দেখালেও ভেতরে প্রতিদিন লড়াই করে, নিজের সাথেই। তবে সুখবর হলো এটি নিরাময়যোগ্য। যখন আপনি লক্ষণগুলো চিহ্নিত করবেন, মনের ভেতরে আলো ঢুকতে শুরু করবে।নিজেকে বিশ্বাস করা কোনো বিলাসিতা নয় এটি বেঁচে থাকার শক্তি।আজই নিজেকে প্রশ্ন করুন-
“আমি কি নিজেকে বিশ্বাস করি?”
যদি উত্তরের মাঝে সন্দেহ থাকে, তাহলে আজ থেকেই মনের এই ‘ক্যান্সার’ নিরাময়ের যাত্রা শুরু করুন।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।