পৃথিবীর আগুনের সাম্রাজ্য কোথায়?-যে দেশটি হয়ে উঠেছে বিশ্বের 'সর্বাধিক আগ্নেয়গিরির জনপদ'
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
পৃথিবীর বুকে এমন কয়েকটি স্থান আছে, যেগুলোকে বোঝা মানে প্রকৃতির গোপন নকশা উন্মোচন করা। আগ্নেয়গিরি সেই রহস্যের সবচেয়ে জীবন্ত উদাহরণ। জ্বলন্ত ম্যাগমার পাহাড়গুলো শুধু ভূমি সৃষ্টি করে না, তারা বদলে দেয় জলবায়ু, গড়ে তোলে দ্বীপ, উর্বর করে মাটি, আবার মুহূর্তেই ধ্বংস করে দিতে পারে পুরো বসতি। আর এ আগ্নেয়গিরিগুলোর মধ্যে একটি দেশ এমনভাবে সবার ওপরে উঠে এসেছে, যাকে পৃথিবীর বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই বলেন-"The Volcano Capital of the World"। এই দেশটি হলো ইন্দোনেশিয়া (Indonesia)।
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি যেসব দেশে আছে, তাদের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া নিঃসন্দেহে এক নম্বরে। এমনকি সক্রিয়, অর্ধ-সক্রিয় ও সম্ভাব্য সক্রিয় আগ্নেয়গিরির সংখ্যায়ও দেশটি অন্যদের অনেক পেছনে ফেলে রেখেছে। তবে কেন ইন্দোনেশিয়ার বুকে এত আগ্নেয়গিরি—এটাই বিজ্ঞানীদের অন্যতম বড় কৌতূহল।
কেন ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর আগ্নেয় সাম্রাজ্য?
ইন্দোনেশিয়া এমন এক ভূখণ্ডের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে, যাকে বিজ্ঞানীরা বলেন Ring of Fire (আগুনের বলয়)। এটি প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে থাকা একটি বিশাল ভূতাত্ত্বিক অঞ্চল, যেখানে পৃথিবীর বেশিরভাগ ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি হয় পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটগুলোর সংঘর্ষের কারণে।
ইন্দোনেশিয়ার নিচে তিনটি বিশাল প্লেট ক্রমাগত ধাক্কা খাচ্ছে-
☞ ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেট।
☞ ইউরেশিয়ান প্লেট।
☞ প্যাসিফিক প্লেট।
এই তিন প্লেটের বিরামহীন সংঘর্ষ, চ্যাপ্টা হওয়া, ডুবতে থাকা ও উত্তোলনের মধ্যেই জন্ম নেয় আগ্নেয়গিরি। এটি এমন একটি ভূতাত্ত্বিক পরীক্ষাগার, যেখানে মাটির নিচে প্রতিনিয়ত উত্তপ্ত ম্যাগমার বিশাল কারখানা কাজ করে যাচ্ছে। ফলে ইন্দোনেশিয়া যেন প্রকৃতির এক বিশাল 'ভূগর্ভস্থ আগুনের কারখানার' ওপরে বসে থাকা দেশ।
ইন্দোনেশিয়ায় মোট কত আগ্নেয়গিরি?
বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ডেটাবেস অনুযায়ী— ১৩০টিরও বেশি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে দেশটিতে। মোট আগ্নেয়গিরির সংখ্যা—১৭০+। প্রতি বছর কয়েক ডজন আগ্নেয়গিরিতে বাষ্প, ছাই, বা ছোটখাটো বিস্ফোরণ ঘটে। এগুলো শুধু পাহাড় নয়; এগুলো দেশের ভূগোল, জলবায়ু, লোকসংস্কৃতি, অর্থনীতি—সবকিছু বদলে দেয়। ইন্দোনেশিয়ার অনেক দ্বীপ, যেমন—জাভা, সুলাওয়েসি, সুমাত্রা মূলত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল। অর্থাৎ আজ যেসব দ্বীপে কোটি মানুষ বাস করে, সেগুলো একসময় ছিল প্রকৃতির আগুনের কারুশিল্প।
সবচেয়ে ভয়ংকর ইতিহাস, যে অগ্ন্যুৎপাতে পৃথিবীর জলবায়ু বদলে গিয়েছিল
১) ক্রাকাতোয়া (Krakatoa, 1883)- মানবসভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম ভয়ংকর শব্দ, ক্রাকাতোয়ার বিস্ফোরণ। বিজ্ঞানীরা বলেন, এটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে বিস্ফোরণের শব্দ ৪,৮০০ কিমি দূর পর্যন্ত শোনা গিয়েছিল। সমুদ্রের ঢেউ ৪০ মিটার পর্যন্ত উঠে যায়। আকাশে ছাই ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় ১.২°C কমে যায়। ইন্দোনেশিয়ার ভূগোলকে পুরোপুরি পাল্টে দেওয়া এই অগ্ন্যুৎপাত বিজ্ঞানীদের চোখ খুলে দেয় আগ্নেয়গিরির বৈশ্বিক শক্তি সম্পর্কে।
২) মাউন্ট তাম্বোরা (Mount Tambora, 1815)- এটি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অগ্ন্যুৎপাতগুলোর একটি। এর বিস্ফোরণে যে পরিমাণ ছাই আকাশে গিয়েছিল, তাতে পৃথিবীতে আসে "The Year Without a Summer"- ইউরোপে ফসলহানি, দুর্ভিক্ষ, উত্তর আমেরিকায় অস্বাভাবিক ঠান্ডা। একটি দেশের আগ্নেয়গিরি কীভাবে পুরো পৃথিবীর আবহাওয়া পাল্টে দিতে পারে, Tambora তার জীবন্ত উদাহরণ।
মানুষের জীবনে আগ্নেয়গিরির প্রভাব-হুমকি যেমন, আশীর্বাদও তেমন! ইন্দোনেশিয়ার মানুষের জীবন যেন আগ্নেয়গিরির ছায়াতেই গড়ে উঠেছে। তারা জানে আগুনের পাশে বাস করলে ঝুঁকি আছে, কিন্তু সেই আগুনই দেয় উর্বর মাটি, পর্যটন, খনিজ সম্পদ, এমনকি নতুন ভূমি।
অগ্ন্যুৎপাতের ছাই মাটিকে এত সমৃদ্ধ করে যে দুর্গম পাহাড়েও কৃষিকাজ সম্ভব হয়। এজন্য জাভার জনসংখ্যা এত ঘন, এ অঞ্চল পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর মাটির একটি। আগ্নেয়গিরির নিচে জন্ম নেয় গন্ধক, তামা, নিকেল, সোনা, বিরল খনিজ, যা দেশের অর্থনীতিকে গুরুত্বপূর্ণভাবে সমর্থন করে।
ইন্দোনেশিয়ার আগ্নেয়গিরিগুলো আজ অ্যাডভেঞ্চার পর্যটনের অন্যতম কেন্দ্র। ব্রমো, রিঞ্জানি, মেরাপি এসব নাম বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
ঝুঁকিও কম নয়। প্রায় প্রতি বছর ছোট-বড় অগ্ন্যুৎপাত ঘটে, যেগুলো বাসিন্দাদের জীবনকে থমকে দেয়। তাদের জীবনযাত্রা যেন একটি অদৃশ্য ঘড়ির মতো, যেটি কখন বিস্ফোরিত হবে, তা তারা জানে না; তবুও প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকে।
অন্যান্য দেশ-কে কতদূরে?
যদিও ইন্দোনেশিয়া শীর্ষে, আরও কয়েকটি দেশ আছে আগ্নেয়গিরিতে সমৃদ্ধ। কিন্তু কেউই ইন্দোনেশিয়ার দেখা পায় না সংখ্যায় বা সক্রিয়তার দিক থেকে।
◑ জাপান:Ring of Fire–এ অবস্থিত জাপানে শতাধিক আগ্নেয়গিরি আছে। তবে দ্বীপদেশ হওয়ায় জনসংখ্যা ও স্থাপনা প্রভাব বেশি।
◑ যুক্তরাষ্ট্র:বিশেষ করে আলাস্কা, হাওয়াই ও পশ্চিমাঞ্চলে বহু আগ্নেয়গিরি রয়েছে। হাওয়াইয়ের "shield volcano"—বিশ্বের অন্যতম অনন্য ভূতাত্ত্বিক কাঠামো।
◑ রাশিয়া (কামচাটকা অঞ্চল): এখানে বিশ্বের সবচেয়ে সক্রিয় আগ্নেয়গিরিগুলোর কয়েকটি রয়েছে, তবে জনবসতি কম হওয়ায় প্রভাব তুলনামূলক সীমিত।
◑ ফিলিপাইন: ইন্দোনেশিয়ার মতো একই ভূতাত্ত্বিক অঞ্চলে হওয়ায় আগ্নেয়গিরির ঝুঁকি বেশি।
পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেট ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে, তাই আগ্নেয়গিরির অবস্থান ভবিষ্যতে এক নতুন ভূম্যাপ সৃষ্টি করবে বলে, বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ইন্দোনেশিয়া এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
⇨ ভবিষ্যতে নতুন দ্বীপ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা। নতুন আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচ থেকে নতুন ভূমি তুলে আনতে পারে, যেমন আগেও হয়েছে।
⇨ জলবায়ু পরিবর্তনের জটিলতা। একটি বড় অগ্ন্যুৎপাত পুরো পৃথিবীর তাপমাত্রাকে প্রভাবিত করতে পারে—বরফ গলে যাওয়া, বৃষ্টিপাতের ধরণ বদলে যাওয়া, ঝড় বৃদ্ধি সবকিছুই এতে যুক্ত।
⇨ বিজ্ঞানীদের বিশাল গবেষণাকেন্দ্র- ইন্দোনেশিয়ার আগ্নেয়গিরিগুলো পৃথিবীর ভেতরের গঠন ও গতিবিধি বুঝতে বিশেষ সুযোগ দেয়। প্রতিটি অগ্ন্যুৎপাত যেন প্রকৃতির একটি পরীক্ষাগার।
পৃথিবীর সবচেয়ে আগ্নেয়গিরিসমৃদ্ধ দেশ হওয়া মানে শুধু বিপদের মুখোমুখি থাকা নয়। এটি টিকে থাকার এক অবিশ্বাস্য গল্প।জাভা দ্বীপের কৃষকরা উৎসবের মতো করে আগ্নেয়গিরিকে সম্মান জানায়, কারণ তাদের বিশ্বাস এই আগুনই তাদের জীবনের রুটি-রুজি। পর্যটকেরা পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখতে দেখতে বিস্মিত হয় প্রাচীন আগুনের শক্তিতে। বিজ্ঞানীরা এর প্রতিটি পরিবর্তন মেপে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ অধ্যয়ন করেন। ইন্দোনেশিয়ার আগ্নেয়গিরি তাই শুধু পাহাড় নয়, এগুলো মানুষের জীবন, সংস্কৃতি, শিল্প, অর্থনীতি ও পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক সময়রেখার এক জীবন্ত পাঠ্যবই।
যে প্রশ্ন দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল- বিশ্বের সবচেয়ে আগ্নেয়গিরির দেশ কোনটি? উত্তর শুধু একটি নাম নয়; এটি এক গভীর ভূতাত্ত্বিক বাস্তবতা, ইন্দোনেশিয়া হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ, সবচেয়ে সক্রিয় এবং সবচেয়ে জটিল আগ্নেয়গিরির দেশ। এটি এমন একটি ভূখণ্ড, যেখানে মাটি যেমন নতুন জীবন তৈরি করে, তেমনি আগুন মুহূর্তেই তার ছাপ বদলে দিতে পারে। ইন্দোনেশিয়া আসলে পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের সহাবস্থানের এক ব্যতিক্রমী গল্প, যেখানে আগ্নেয়গিরির গর্জন ভয় নয় বরং পৃথিবীর শ্বাসের শব্দ।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।