বয়স বাড়লেও স্মৃতিশক্তি ঝকঝকে থাকার রহস্য: সব শুরু হয় শৈশবের পাতা থেকে!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বই–পড়া আমাদের সংস্কৃতির এক পুরোনো অভ্যাস। কিন্তু শিশু বয়সে এই অভ্যাস গড়ে ওঠা শুধু ভাষা শেখা বা কল্পনাশক্তি বাড়ানোর জন্য নয়, এটি মানুষের মস্তিষ্কের দীর্ঘমেয়াদি বিকাশে যে প্রবল প্রভাব ফেলে, তা এখন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রশ্নটি তাই নতুন করে উঠে এসেছে—ছোটবেলায় বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুললে কি সত্যিই বড় বয়সে স্মৃতিশক্তি থাকে আরও প্রখর! এই প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও দীর্ঘমেয়াদি মানব–অভ্যাসচর্চার গবেষণায় ধাপে ধাপে পরিষ্কার হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, শৈশবের পাঠ–অভ্যাস শুধু একাডেমিক উন্নতি নয়। এটি মস্তিষ্কের গঠন, চিন্তা–প্রক্রিয়া, স্মৃতি সংরক্ষণ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এমনকি বৃদ্ধ বয়সে জ্ঞানের ক্ষয় কমিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখে।
একটি শিশুর জন্মের সময় তার মস্তিষ্কে প্রায় ১০০ বিলিয়ন নিউরন থাকে, কিন্তু সংযোগ বা ‘সাইনাপ্স’ সংখ্যা তখনো সীমিত। ১–১০ বছর বয়সকে বিজ্ঞানীরা বলেন,নিউরাল প্লাস্টিসিটির সোনালি সময়। এই সময় মস্তিষ্ক নতুন তথ্য গ্রহণে অত্যন্ত প্রস্তুত। যেকোনো অভ্যাসের প্রতিক্রিয়ায় দ্রুত পরিবর্তিত হয়। ভাষা, চিন্তা, অনুভূতি ও স্মৃতির ভিত্তি তৈরিতে ব্যস্ত থাকে। ঠিক এই সময়েই বই–পড়া মস্তিষ্কে শক্তিশালী নিউরাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে।
বই–পড়া মস্তিষ্ককে যে ৬টি উপায়ে বদলে দেয়
১) শব্দ–ধ্বনি–অর্থের সংযোগ তৈরি হয় দৃঢ়ভাবে।পড়ার সময় শিশুর মস্তিষ্ক ভাষার প্রতিটি অংশকে সক্রিয় করে। শব্দ সনাক্তকরণ, উচ্চারণ, ধ্বনির মিল, অর্থ বোঝা, বাক্যের সম্পর্ক- এই পাঁচটি প্রক্রিয়া একসঙ্গে সক্রিয় হওয়ায় মস্তিষ্কে শক্তিশালী সাইনাপটিক পথ তৈরি হয়, যা পরিণত বয়সে স্মৃতির অবনতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতিরোধ করে।
২) পড়া মানেই মস্তিষ্কের “ওয়ার্কআউট”! যখন শিশু কোনো শব্দ বা ঘটনা বোঝে তখন মস্তিষ্কে একই সঙ্গে সক্রিয় হয়-
◑ স্মৃতি সংরক্ষণের অংশ (হিপোক্যাম্পাস)
◑ বিশ্লেষণ অংশ (প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স)
◑ দৃশ্যায়ন অংশ (অক্সিপিটাল লোব)
যেমন একজন দৌড়বিদ নিয়মিত দৌড়ালে তার পেশি শক্তিশালী হয়, ঠিক তেমনই বই–পড়া নিউরনগুলোর পুনরাবৃত্তি–সংযোগ বাড়ায়। এটি পরিণত বয়সে ‘কগনিটিভ রিজার্ভ’ তৈরি করে। অর্থাৎ, বয়স–সম্পর্কিত স্মৃতি সমস্যা দেরিতে শুরু হয়।
৩) গল্প পড়া আবেগ ও স্মৃতির সম্পর্ককে মজবুত করে! গল্পের চরিত্র, ঘটনা, উত্তেজনা, দুঃখ, আনন্দ—সবই আবেগকে সক্রিয় করে। আবেগের সঙ্গে যুক্ত স্মৃতিগুলো মস্তিষ্ক সবচেয়ে গভীরভাবে সংরক্ষণ করে। এ কারণেই, শিশুকালের পড়া গল্পগুলো বহু বছর পরেও অনেকেই স্পষ্ট মনে রাখতে পারে। এই অভ্যাস মস্তিষ্ককে শিখিয়ে দেয় কীভাবে তথ্যকে সাজিয়ে স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়।
৪) বই–পড়া শিশুদের মনোযোগ ক্ষমতা বেড়ে যা। প্রযুক্তির যুগে মনোযোগ কমে যাওয়াই নতুন সমস্যা। কিন্তু বই–পড়ার সময় চোখ ও মস্তিষ্ক স্থির থাকে, দীর্ঘ সময় এক বিষয়ের ওপর ফোকাস ধরে রাখতে হয়, বিকল্প উত্তেজনার উৎস কম থাকে। ফলে শিশুদের মনোযোগ–স্থায়িত্ব (attention span) বাড়ে। এই দক্ষতা বড় বয়সে স্মৃতি মনে রাখার ক্ষমতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
৫) শব্দভাণ্ডার বাড়লে মস্তিষ্ক তথ্য সাজাতে শিখে। শব্দ যত বেশি জানা থাকবে, চিন্তা–ভাবনা তত সুনির্দিষ্ট হয়। এটি স্মৃতিশক্তিকে সাহায্য করে। কারণ, পরিষ্কার চিন্তাই তথ্য সহজভাবে সংরক্ষণ করতে পারে আর অগোছালো চিন্তায় স্মৃতি দ্রুত হারিয়ে যায়। গবেষণা দেখায়, শিশু বয়সে বড় শব্দভাণ্ডার ভবিষ্যতের স্মৃতি পরীক্ষায় উচ্চ স্কোরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
৬) বই–পড়া মস্তিষ্ককে সংযোগকারীর মতো কাজ করায়! বই পড়ার সময় মস্তিষ্ক একসঙ্গে বিশ্লেষণ, কল্পনা, পূর্ব অভিজ্ঞতা, পরিবেশ, যুক্তি—এসবের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে। এই সংযোগক্ষমতাই বয়স বাড়লেও মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণে দেখানো হয়েছে-
যারা ছোটবেলা নিয়মিত বই পড়েছে, তাদের হিপোক্যাম্পাস বেশি সক্রিয় থাকে। বয়স ৫০–৭০ হলেও তাদের স্মৃতি–ক্ষমতা তুলনামূলক বেশি স্থিতিশীল। সিদ্ধান্ত নেওয়া, পরিকল্পনা করা ও ভাষাগত বিশ্লেষণেও তারা এগিয়ে থাকে। বয়সজনিত জ্ঞানহানি (cognitive decline) তাদের মধ্যে ধীরগতিতে ঘটে। যদিও এসব গবেষণার উদ্দেশ্য মস্তিষ্কের প্রবণতা বোঝা, তবুও এতে স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে- শৈশবের পাঠ–অভ্যাস মস্তিষ্ককে বার্ধক্য পর্যন্ত শক্তিশালী রাখে।
মস্তিষ্কে কগনিটিভ রিজার্ভ বলতে বোঝায়- বয়স বাড়ার পরেও মস্তিষ্কে চিন্তা, স্মৃতি ও বিশ্লেষণ ধরে রাখার অতিরিক্ত ক্ষমতা। শৈশবের বই–পড়া নিউরন সংযোগ বাড়ায়, মস্তিষ্কে তথ্য সংরক্ষণের পথ প্রশস্ত করে, সমস্যা সমাধান ক্ষমতা বাড়ায়, আবেগ নিয়ন্ত্রণ শক্তি উন্নত করে। ফলে মস্তিষ্কের ওপর বয়সজনিত চাপ পড়লেও স্মৃতি দ্রুত নষ্ট হয় না।
ডিজিটাল যুগে বই–পড়ার প্রয়োজন আরও বেশি কেন?
যে যুগে ভিডিও, দ্রুতগতির তথ্য, রিল–শর্ট ভিডিও, গেম—এসব শিশুদের মনোযোগকে ভেঙে দিচ্ছে, সে যুগে বই–পড়া মনোযোগকে প্রশিক্ষিত করে।স্ক্রিনভিত্তিক কনটেন্টে মস্তিষ্ক তথ্য খুব দ্রুত পায়, কিন্তু বই–পড়ায় মস্তিষ্ককে শ্রম দিতে হয়। এই শ্রমই স্মৃতি–শক্তি বাড়ায়।
শৈশবে বই–পড়া কীভাবে অভ্যাসে পরিণত করা যায়?
⇨ দৈনিক ১০ মিনিট পড়ার সময়
⇨ বিষয়ভিত্তিক বই নির্বাচন
⇨ পরিবারের কারও সঙ্গে বই–আলোচনা
⇨ বই হাতে থাকার সুযোগ তৈরি
পাঠ–অভ্যাস চাপ নয়, আনন্দ হতে হয়। তবে সেটি নিয়মিত হলে মস্তিষ্ক স্থায়ীভাবে বদলে যায়।
বড় হয়ে স্মৃতিশক্তি ধরে রাখতে বই–পড়া কীভাবে সাহায্য করে?
১) বয়স বাড়লেও নিউরন সক্রিয় থাকে।
২) নিয়মিত পড়া স্ট্রেস কমায়।
৩) মনোযোগ ক্ষমতা বাড়ে।
৪) মস্তিষ্কে নতুন সাইনাপ্স তৈরি হয়।
৫) শব্দভাণ্ডার তথ্যকে সহজে সংগঠিত করতে সাহায্য করে।
৬) বিশ্লেষণ ক্ষমতা শক্তিশালী থাকে।
৭) ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমে।
কেউ যদি সারা জীবন বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখে, সেই মস্তিষ্ক বয়সেও সক্রিয়তা হারায় না।
শৈশবে বই–পড়া শুধু চরিত্র গঠনের অংশ নয়। এটি এক ধরনের মস্তিষ্কে বিনিয়োগ। এই অভ্যাস শিশুদের মনোযোগ, ভাষা, বিশ্লেষণ, স্মৃতিশক্তি ও মানসিক স্থিতি সবকিছুকে সমৃদ্ধ করে, যার প্রভাব তারা পুরো জীবন ধরে বহন করে। বয়স বাড়লেও স্মৃতি কেন তীক্ষ্ণ থাকে। কারণ শৈশবের বই–পড়া মস্তিষ্ককে এমন শক্ত ভিত্তি দেয় যা সময়ের ক্ষয়েও সহজে ভেঙে পড়ে না। তাই পরিবারে ছোটদের বই–আসনের অভ্যাস তৈরি করা মানে- ভবিষ্যতের এক সুস্থ, স্থির, প্রখর–বুদ্ধির মানুষ তৈরি করার এক নিঃশব্দ কিন্তু অপরিহার্য কাজ।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।