গর্ভাবস্থার অসুবিধায় ঘরোয়া উপায়-প্রাকৃতিক সমাধানেই মিলবে মায়ের আরাম ও শিশুর নিরাপত্তা!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
গর্ভাবস্থা মানেই এক অসাধারণ যাত্রা। শরীরে নতুন প্রাণের স্পন্দন, জীবনের নতুন অধ্যায়ের সুখ, অজানার উত্তেজনা এবং পাশাপাশি নানান শারীরিক–মানসিক পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার কঠিনতা। বিশ্বস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, গর্ভাবস্থায় প্রতিটি নারী কমবেশি অসুবিধার মধ্য দিয়ে যান, এবং সেই অসুবিধাগুলোর অনেকগুলোরই ঘরোয়া, নিরাপদ ও প্রাকৃতিক সমাধান রয়েছে। এই সমাধানগুলো- ⇨ মায়ের জন্য নিরাপদ ⇨ শিশুর বৃদ্ধিবিকাশে কোনো বাধা দেয় না ⇨ সহজলভ্য
বমিভাব ও বমি (Morning Sickness), গর্ভাবস্থার প্রথম চ্যালেঞ্জ!
গর্ভাবস্থায় ৭০–৮০% নারীই বমিভাবে ভোগেন।এর প্রধান কারণ হরমোনের হঠাৎ বৃদ্ধি (বিশেষত hCG ও ইস্ট্রোজেন)।
সমাধান:
১) আদা, বমিভাব কমানোর সবচেয়ে পরিচিত প্রাকৃতিক উপাদান। আদায় আছে জিঞ্জারল ও শোগাওল, যা পেটের অস্বস্তি কমায়।
যেভাবে খাবেন: হালকা গরম পানিতে আদা সেদ্ধ করে আদা–চা, ছোট করে কাটা আদা চিবিয়ে খাওয়া, স্যুপে সামান্য আদা।
২) লেবু পানি বা লেবুর গন্ধ নেয়া।লেবুর প্রাকৃতিক গন্ধ বমিভাব দ্রুত কমায়। হালকা লেবু–পানি চুমুক দিয়ে খেলে পেটের অস্বস্তি কমে।
৩) অল্প অল্প করে বারবার খাওয়া। পেট খালি থাকলে বমিভাব বাড়ে। প্রতিবার অল্প অল্প ফল, বিস্কুট বা স্যুপ খাবেন।
৪) অনেক হবু মায়েদের গরম খাবারে বমি লাগে। তাই দই, ঠাণ্ডা ফল বা ঠাণ্ডা পানি- আরাম দেয়।
অম্বল, গ্যাস ও বুকজ্বালা-হরমোন পরিবর্তনের অস্বস্তিকর উপহার!
গর্ভে শিশুর বৃদ্ধি এবং হরমোনের কারণে পাচনক্রিয়া তুলনামূলক ধীর হয়। ফলে অম্বল, গ্যাস, বুকজ্বালা দেখা দেয়।
সমাধান:
১) খাবারের পরে এক মুঠো মৌরি খান। মৌরি হজমে সাহায্য করে, পেটে গ্যাস কমায় এবং অম্বল প্রশমিত করে।
২) নারিকেল পানি পান করতে পারেন। প্রাকৃতিক ইলেকট্রোলাইট শরীরে ভারসাম্য রাখে এবং পাকস্থলীর অম্লতা কমায়।
৩) দইয়ের ভালো ব্যাকটেরিয়া হজমশক্তি বাড়ায়, বুকজ্বালা কমায়।
৪) তিলের সেঁকা পানি- হজম উন্নত করে, গ্যাস কমায় এবং অম্লতা নিয়ন্ত্রণ করে।
৫) অল্প পরিমাণে আদা ও মধু, গ্যাস ও অম্বল কমায়।
কোষ্ঠকাঠিন্য, গর্ভাবস্থায় সবচেয়ে বিরক্তিকর সমস্যা!
হরমোনের পরিবর্তন ও শিশুর বাড়তি চাপের কারণে অন্ত্রের গতি কমে যায়।
সমাধান:
১) আঁশ–সমৃদ্ধ খাবার,যেমন : সবুজ শাক, ফল (পেঁপে, আপেল, নাসপাতি, কমলা), ওটস, লাউ, চিঁড়া খাবেন।
২) প্রতিদিন সকালে খালি পেটে কুসুম গরম পানি মলত্যাগে সাহায্য করে।
৩) এক চা–চামচ ইসবগুল ১০০–২০০ মিলি পানিতে মিশিয়ে খেলে সহজে মলত্যাগ হয়।
৪) পেঁপে, প্রাকৃতিক এনজাইম হজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সাহায্য করে।
৫) নিয়মিত হালকা হাঁটা, পাচনক্রিয়া স্বাভাবিক রাখে।
কোমরব্যথা ও পিঠে ব্যথা, শরীরের ভারসাম্য বদলে যাওয়ার ফল!
শিশু বড় হলে শরীরের ভার কেন্দ্র সামনের দিকে সরে যায়। ফলে কোমর, পিঠ, নিতম্বে ব্যথা খুবই সাধারণ।
সমাধান:
১) গরম পানির সেঁক। ব্যথা কমায় এবং মাংসপেশি শিথিল করে।
২) হালকা স্ট্রেচিং- বিড়ালের মতো পিঠ বাঁকানো, হালকা যোগ–ব্যায়াম, শ্বাস–প্রশ্বাস ব্যায়াম
- এগুলো কোমর–পিঠের চাপ কমায়।
৩) গরম দুধে হলুদ- হলুদের প্রদাহবিরোধী গুণ ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
৪) ম্যাসাজ (অভিজ্ঞ ব্যক্তির মাধ্যমে)- সাধারণ তিল বা নারকেল তেল গরম করে হালকা ম্যাসাজ করলে ব্যথা কমে।
পায়ে ক্র্যাম্প, হঠাৎ ব্যথায় ঘুম ভেঙে যাওয়া!
ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়ামের ঘাটতি থেকে ভুল–পা (Leg Cramp) হয়।
সমাধান:
১) গরম পানি দিয়ে পা ভেজানো- পেশি শিথিল করে।
২) কলা পটাশিয়ামসমৃদ্ধ, তাই ক্র্যাম্প কমায়।
৩) তিল/কালোজিরা- ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম মাংসপেশির খিঁচুনি কমায়।
৪) পায়ের গোড়ালি ঘুরিয়ে ব্যায়াম, রক্তসঞ্চালন বাড়িয়ে দেয়।
পা–ফোলা বা হাতে–মুখে ফোলাভাব, গর্ভাবস্থার সাধারণ শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন!
প্রসবের শেষদিকে শরীরে পানি জমা স্বাভাবিক। তবে অস্বস্তিকর লাগতে পারে।
সমাধান:
১) পা উঁচু করে রাখা। দিনে ২–৩ বার ১৫–২০ মিনিট পা উঁচু করে রাখলে ফোলা কমে।
২) লেবু–পানি খাওয়া। এটি হালকা মূত্রবর্ধক এবং ফোলাভাব কমাতে সাহায্য করে।
৩) শসা, প্রাকৃতিকভাবে পানি–নিয়ন্ত্রণ করে।
৪) পুদিনা–পানিতে পা ভেজানো, ঠাণ্ডা ও প্রশান্তিদায়ক।
অনিদ্রা, হরমোন বদলে ঘুম চলে যায় অস্থির হয়ে!
গর্ভাবস্থায় ঘুম কমে যাওয়া খুব সাধারণ।সাথে রয়েছে শারীরিক অস্বস্তি, টেনশন, ঘনঘন প্রস্রাব।
সমাধান:
১) গরম দুধ- ট্রিপটোফ্যান ঘুম আনতে সাহায্য করে।
২) ক্যামোমাইল বা তুলসী–চা (ক্যাফেইন ছাড়া), মন শান্ত করে, অস্থিরতা কমায়।
৩) ঘুমানোর আগে হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল, শরীর রিল্যাক্স করে।
৪) ঘর অন্ধকার ও নীরব রাখা, মেলাটোনিন উৎপাদনে সহায়তা করে।
ত্বকের সমস্যা- দাগ, র্যাশ, ব্রণ, চুলকানি!
হরমোনের কারণে ত্বকে নানা পরিবর্তন আসে।
সমাধান:
১) অ্যালোভেরা জেল-ত্বকের জ্বালা কমায়, র্যাশ প্রশমিত করে।
২) নারকেল তেল- শুষ্ক ত্বক ও চুলকানি কমায়।
৩) শসা–ফেসপ্যাক- ত্বক ঠাণ্ডা করে, দাগ কমায়।
৪) ত্বকে অতিরিক্ত সাবান ব্যবহার কমানো। সাবান ত্বক শুকিয়ে দেয়,ফলে চুলকানি বাড়ে।
মাথাঘোরা বা দুর্বলতা, রক্তে শর্করা কমের সমস্যা!
গর্ভাবস্থায় ব্লাড সুগার হঠাৎ কমে গেলে মাথা ঘোরা খুব সাধারণ।
সমাধান:
১) খেঁজুর- তাৎক্ষণিক শক্তি দেয়।
২) লেবু–মধু–পানি- দ্রুত শক্তি দেয়, মাথাঘোরা কমে।
৩) অল্প করে বারবার খাবার- একবারে বেশি না খেয়ে ৫–৬ বার ছোট খাবার।
৪) লবণ–জল- যদি শরীরে লবণ কমে যায়, তবে মাথা ঘোরা দেখা দেয়।এক্ষেত্রে সামান্য লবণ–মিশ্রিত পানি উপকারী।
শ্বাসকষ্ট, শিশু বড় হলে ফুসফুসের জায়গা কমে যায়!
গর্ভাবস্থার শেষ দিকে শ্বাস নিতে অস্বস্তি হওয়া স্বাভাবিক।
সমাধান:
১) বালিশ উঁচু করে ঘুম- ফুসফুসে চাপ কমে।
২) ধীরে ধীরে গভীর শ্বাস–প্রশ্বাস- ডায়াফ্রাম রিল্যাক্স করে।
৩) খুব বেশি ভারী খাবার না খাওয়া- পেট ভরে গেলে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়।
মানসিক চাপ ও উদ্বেগ-হরমোনের ওঠানামা + অজানা ভয়!
গর্ভাবস্থায় মায়ের মন সবচেয়ে সংবেদনশীল। অনেক মা অকারণে কাঁদেন, টেনশনে থাকেন, ভয় পান, মুড সুইং হয়।
সমাধান:
১) পরিবারের সমর্থন- মায়ের মানসিক শান্তি সবচেয়ে বড় ওষুধ।
২) হালকা যোগব্যায়াম- মস্তিষ্কের ‘হ্যাপি হরমোন’ বাড়ায়।
৩) তুলসী বা লেবু–বাম্বু চা- মনকে শান্ত করে।
৪) মন ভালো থাকে এমন কাজ করা। হাঁটা, বই পড়া, গান শোনা সবই মন ভালো রাখতে সাহায্য করে।
গর্ভাবস্থা চ্যালেঞ্জিং, কখনো ক্লান্তিকর, আবার কখনো আনন্দে ভরা। এই পুরো সময়ে হবু মা শারীরিক, মানসিক, হরমোনগত—সব ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যান। বেশিরভাগ সমস্যা খুবই স্বাভাবিক, এবং এদের অনেকগুলোরই ঘরোয়া, নিরাপদ, প্রাকৃতিক সমাধান রয়েছে। এই সমাধানগুলো মাকে স্বস্তি দেয়, শিশুকে নিরাপদ রাখে, মনে শান্তি আনে। মা যত শান্ত থাকেন, শিশুর বৃদ্ধি তত ভালো হয়। এটাই সত্য। গর্ভাবস্থা কোনো রোগ নয়, এটি জীবনের এক সুন্দর পরিবর্তন। সঠিক যত্ন, সুষম খাদ্য, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, পরিবারের সহযোগিতা এবং কিছু প্রাকৃতিক ঘরোয়া উপায়, এই যাত্রাকে আরও সহজ, আরও সুন্দর ও আরও নিরাপদ করে তুলতে পারে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।