বাবা হওয়ার আগে এই মানসিক পরীক্ষা পাস করতে হয়-বেশিরভাগই জানে না!

বাবা হওয়ার আগে এই মানসিক পরীক্ষা পাস করতে হয়-বেশিরভাগই জানে না!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

সমাজে আমরা যখন “ভালো বাবা” শব্দবন্ধটি শুনি, তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক নিরলস পরিশ্রমী মানুষের চিত্র। যিনি সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নিজের জীবনটাকেই যেন গুছিয়ে রেখেছেন শুধু একটাই লক্ষ্যে- সন্তান যেন আরামের, নিরাপত্তার, আদরের একটি পৃথিবী পায়। আমাদের পরিবারের অন্দরমহল, আত্মীয়স্বজন কিংবা প্রতিবেশীদের দিকে তাকালেই এমন বাবার অভাব নেই। পরম আত্মনিবেদনে যারা সন্তানকে লালন-পালন করেন, নিজেরা ক্ষুধার্ত থেকেও সন্তানকে খাইয়ে দেন, মাথার ওপরে আকাশের মতো ছায়া দিয়ে সারাজীবন সন্তানকে আগলে রাখেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো এটাই কি “ভালো বাবা”-র পূর্ণ সংজ্ঞা? শুধু দায়িত্ব পালন, অর্থ উপার্জন, সন্তানের চাহিদা পূরণ, ক্লান্ত শরীর নিয়ে রাতের শেষে ঘরে ফিরেও সন্তানকে বুক ভরে আদর করা এসবই কি যথেষ্ট? নাকি “ভালো বাবা” শব্দটির ভেতরে আরও গভীর কোনো সত্য লুকিয়ে আছে, যেটি আমরা অনেক সময়ই এড়িয়ে যাই?

মানুষ হিসেবে আমরা যতই পরিণত হচ্ছি, ততই বুঝতে পারছি সন্তানকে শুধু অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বা ভালোবাসা দিলেই চলবে না। বাবা হিসেবে একটি মানুষ তার সন্তানের চোখে যে প্রথম রোল মডেল, প্রথম নৈতিক পথপ্রদর্শক, প্রথম মানসিক কাঠামো গড়ার স্থপতি- এ ধারণাটিকে উপেক্ষা করা শুধু অসম্পূর্ণ নয়, তা বিপজ্জনকও হতে পারে।

আমরা সাধারণত বাবার ভালোত্ব যাচাই করি তার দায়িত্ব পালন দিয়ে। সে কি অর্থ উপার্জন করে? সন্তানের প্রতি যত্নশীল? চাহিদা পূরণে চেষ্টা করেন? সন্তানের স্বপ্ন পূরণের জন্য সংগ্রাম করেন? এসব মাপকাঠিতে বেশিরভাগ বাবাই সমাজের চোখে “ভালো”র শিরোপা পেয়ে যান। কিন্তু যদি একজন বাবা— নিজের স্ত্রীকে অপমান করেন, গালাগালি করেন, কখনো শারীরিক নির্যাতন পর্যন্ত করেন, নিজের বৃদ্ধ বাবা-মাকে অবহেলা করেন, তাদের প্রতি কর্তব্য ভুলে যান, সমাজে বা কর্মক্ষেত্রে দুর্নীতি করেন, অনৈতিক পথে অর্থ উপার্জন করেন, মানুষের প্রতি অসম্মান দেখান, অহংকারে ডুবে থাকেন, অন্যের ক্ষতি করতে পিছপা হন না তাহলে কি তিনি সত্যিই ভালো বাবা! 

সন্তানকে ভালোবাসা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু শুধু ভালোবাসা যথেষ্ট নয়। সন্তানের সামনে যে মানুষটিকে তারা প্রতিদিন দেখছে, তার প্রতিটি আচরণই সন্তান শোষণ করে নেয় নিজের ভবিষ্যৎ চরিত্র গঠনের কাঠামোয়। অর্থাৎ, আমি কেমন মানুষ, সেটাই আমার সন্তানের ভবিষ্যৎকে নির্ধারণ করবে।

মনোবিজ্ঞানীরা বহু গবেষণায় দেখিয়েছেন, শিশুরা বাবা-মায়ের আচরণ কেবল শোনে না, বরং অনুকরণ করে। যে সন্তান নিয়মিত দেখে তার বাবা মাকে সম্মান করছেন,  কথা বলছেন ধীরে এবং  শান্তভাবে, মতবিরোধ হলেও গঠনমূলক আলোচনায় সমস্যার সমাধান করছেন,  নিজেদের বাবা-মায়ের যত্ন নিচ্ছেন, অন্যকে ঠকানো নয় বরং  পরিশ্রম দিয়ে নিজের অবস্থান গড়ে তুলছেন, নৈতিকতা ও ইমানদারিকে জীবনের প্রথম শর্ত মনে করছেন, সে সন্তান জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এ মূল্যবোধ বহন করে।

অন্যদিকে, বাবা যদি রাগী, নারীবিদ্বেষী, সহিংস, অসৎ, দায়িত্বহীন, সামাজিকভাবে বিদ্বেষপূর্ণ আচরণকারী হয়ে থাকে, সেই পরিবেশে বেড়ে ওঠা সন্তানও অজান্তেই শিখে ফেলে, কীভাবে অন্যকে অবমূল্যায়ন করতে হয়, কীভাবে পরিবারে বিবাদ তৈরি হয়, কীভাবে দুর্নীতিকে স্বাভাবিক ভাবতে হয়।অর্থাৎ বাবা যেমন, সন্তানের মনেও তেমনই ছাঁচ ঢুকে যায়। সন্তানের চরিত্র শুধু উপদেশে নয়, বাবার প্রতিদিনকার আচরণের মাধ্যমে গড়ে ওঠে।

একজন বাবার “ভালো” হওয়া পরীক্ষা হয় প্রথমেই ঘরের ভেতরে। সন্তান যে মানুষটির প্রথম সম্পর্ক দেখে, প্রথম নিরাপত্তা অনুভব করে, প্রথম বিশ্বাস গড়ে তোলে, তা হলো বাবা-মায়ের সম্পর্ক। যে সন্তান দেখে বাবা মাকে সম্মান করছে, তার মতামত গুরুত্ব দিচ্ছে, কাজের ভাগাভাগি করছে, বিরোধ হলে সঠিকভাবে সমাধান করছে, কখনো অপমান করছে না; সে সন্তানের কাছে সম্পর্ক মানেই সহযোগিতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সুরক্ষা। আর যে সন্তান দেখে বাবা মাকে মারছেন, রাগে গালাগালি করছেন, অপমান করছেন, সন্তান সামনেও অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করছেন, সে সন্তান নিজের ভিতরে গড়ে তোলে ভয়, ক্রোধ, অবিশ্বাস, আত্মমর্যাদাহীনতা, সম্পর্কের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। ছেলে হলে নারীর প্রতি সম্মান হারায়, আর মেয়ে হলে পুরুষের প্রতি ভয় ও অবিশ্বাস জন্মায়। এজন্যই বলা হয়, মায়ের প্রতি বাবার আচরণই সন্তানের চোখে বাবার চরিত্রের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি।

সন্তান ছোটবেলায় বোঝে না নৈতিকতা কী, দায়িত্ব কী, কর্তব্যের সংজ্ঞা কী। সে শুধু দেখেই শেখে। যখন সন্তান দেখে বাবা নিজের বাবা-মায়ের জন্য খাবার তুলে দিচ্ছেন, অসুস্থ হলে দেখাশোনা করছেন, তাদের সম্মান দিচ্ছেন, প্রয়োজন পূরণ করছেন; তখন সন্তানও বড় হয়ে ভাববে,“আমিও একদিন আমার বাবা-মাকে এভাবেই যত্ন করব।” আর যখন দেখে বাবা দাদা-দাদিকে অবহেলা করছেন, তাদের প্রয়োজনকে বোঝা মনে করছেন, তাদের প্রতি বিরক্ত, কখনো বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন! তখন সন্তানও মনে মনে শেখে বৃদ্ধ বাবা-মা মানেই বোঝা। এটি শুধু সামাজিক বাস্তবতা নয়, মানুষের মানসিক বিকাশের বৈজ্ঞানিক সত্য।

একজন বাবা ঘরে সন্তানের জন্য যত আদরই করুন, যদি ঘুষ খান, অন্যের ক্ষতি করে আয় করেন, দুর্নীতি করেন, মিথ্যার আশ্রয় নেন, অন্যের প্রাপ্য কেড়ে নেন! তবে সন্তানের সামনে খুব ভয়ানক উদাহরণ স্থাপন করেন। সন্তান বোঝে অসৎ পথেই উন্নতি হয়।টাকা থাকলেই হয়তো সমাজে সম্মান।সে ভাবতে থাকে  সত্য, ন্যায়, মানবিকতা এসব অপ্রয়োজনীয়। একজন শিশু যখন এমন ধারণা নিয়ে বড় হয়, তখন বাবা যতই তাকে ভালোবাসুক, এই ভালোবাসা সন্তানের চরিত্রকে রক্ষা করতে পারে না। সৎ বাবা মানেই সন্তানের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ, সবচেয়ে দৃঢ় ভবিষ্যতের ভিত্তি।
 

তাহলে “ভালো বাবা” আসলে কাকে বলা যায়?

একজন ভালো বাবা দায়িত্ববান, স্নেহশীল। কিন্তু তার চেয়েও বেশি
তিনি নৈতিক, মানবিক, সম্মানবোধসম্পন্ন, সৎ, ধৈর্যশীল, দায়িত্বশীল এবং ভারসাম্যপূর্ণ। তিনি জানেন, সন্তান শুধু খাবার–পোশাক–শিক্ষা–চাপল্য চায় না,সন্তান চায়—

◑ কীভাবে আচরণ করতে হয়।

◑ কীভাবে সংকটে দৃঢ় থাকতে হয়।

◑ কীভাবে সত্যকে আঁকড়ে ধরতে হয়।

◑ কীভাবে একজন মানুষ হওয়া যায়।

- সেসব দেখার জন্য একটি অনুকরণীয় চরিত্র। তার প্রতিটি সিদ্ধান্তে থাকে সততার ছাপ। প্রতিটি আচরণে থাকে মানবিকতার রং। প্রতিটি কথায় থাকে সম্মান শেখানোর ক্ষমতা।
 

যারা বাবা হয়েছেন, কিংবা ভবিষ্যতে হবেন, তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা যেন মনে রাখেন: বাবা হওয়া কোনো ভূমিকা নয়, এটি মানুষের চরিত্রের প্রসার। আপনি যেমন মানুষ, আপনার সন্তানও ঠিক তেমনই মানুষ হওয়ার প্রবণতা নিয়ে বড় হবে। তাই নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করুন, সম্মান দিন, সম্পর্কের প্রতি যত্নশীল হন, নৈতিকতা আঁকড়ে ধরুন, অসৎ পথ এড়িয়ে চলুন, মানবিকতার চর্চা করুন, কর্মক্ষেত্রে সৎ থাকুন, সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখুন। কারণ একদিন আপনার সন্তানের সামনে প্রশ্ন আসবে—“মানুষ হতে হলে আমাকে কাকে অনুসরণ করতে হবে?” সেই মুহূর্তে যেন তারা আপনার দিকেই তাকিয়ে বলতে পারে “আমি আমার বাবাকে অনুসরণ করব।”

ভালো বাবা হওয়া কেবল দায়িত্বের সফলতা নয়; এটি চরিত্রের মহিমা, আচরণের স্বচ্ছতা, মানবিকতার আলোকবর্তিকা। সন্তানের জীবনে সবচেয়ে বড় স্কুল হলো পরিবার, আর সেই স্কুলের প্রথম শিক্ষক বাবাই। সুতরাং ভালো বাবা হওয়ার পথ শুরু হয় একটি সরল সত্য দিয়ে, আগে মানুষ হও, তারপর বাবা। কারণ সন্তানকে ভালোবাসা গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রয়োজন হলো তাকে এমন একটি চরিত্র উপহার দেওয়া, যা নিয়ে সে সারাজীবন গর্ব করতে পারে, অনুসরণ করতে পারে, এবং একদিন নিজেও তা বয়ে নিয়ে যেতে পারে।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ