শৈশবের বুলিংয়ের মানসিক প্রভাব-নিঃসঙ্গতা, ভয়, আত্মসম্মানের ক্ষয় আর বড় জীবনের লুকানো ঝড়!

শৈশবের বুলিংয়ের মানসিক প্রভাব-নিঃসঙ্গতা, ভয়, আত্মসম্মানের ক্ষয় আর বড় জীবনের লুকানো ঝড়!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

আমাদের সবার কাছে শৈশব সাধারণত রঙিন স্মৃতির, আপেক্ষিক নিরাপত্তার, আর শেখার সোনালি সময়। কিন্তু সবার শৈশব সমান উজ্জ্বল ছিল না। কোনো কোনো শিশুর জন্য সেই সময়ের প্রতিটি সকাল ছিল ভয়ের, লজ্জার, অপমানের। কারণ একটাই—বুলিং।স্কুলের করিডর, খেলার মাঠ, বাসার আশপাশ, এমনকি নিজের পরিবার যেখানেই হোক হাসি-ঠাট্টার নামে অপমান, শারীরিক ভয় দেখানো, বাদ দেওয়া, বকাঝকা, নাম ধরে উপহাস এই সবই শিশুর ভেতরে ধীরে ধীরে জমা করতে থাকে এক গভীর অদৃশ্য ক্ষত। বড় হওয়ার পর সেই ক্ষত শুধু স্মৃতি হিসেবে থাকে না; বরং আচরণ, আত্মবিশ্বাস, সিদ্ধান্ত, সম্পর্ক, এমনকি কর্মজীবন পর্যন্ত প্রভাবিত করে।

বুলিংকে আমরা প্রায়ই খেলাধুলার মজা, ছেলেমানুষি ব্যাপার —এ জাতীয় ভাবনায় হালকা করে দেখি। অথচ মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বুলিং মানে হলো একটি শিশুকে বারবার, ইচ্ছাকৃতভাবে শারীরিক, মানসিক বা সামাজিকভাবে আঘাত করা, যাতে সে নিজেকে দুর্বল, অসহায় বা একাকী মনে করে। বুলিং সাধারণত কয়েকভাবে ঘটে:

◑ শারীরিক ভয় দেখানো।যেমন- ধাক্কা দেওয়া, জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলা, খেলার সময় আঘাত করা
মৌখিক অপমান অর্থাৎ  নাম ধরে খোঁচা দেওয়া, অপমানজনক মন্তব্য

◑ সামাজিক বঞ্চনা।যেমন- দল থেকে বাদ দেওয়া, ইচ্ছা করেই একা ফেলে রাখা।

◑ ডিজিটাল বুলিং, মোবাইল ও সোশ্যাল মিডিয়া দিয়ে অপমান ছড়ানো।
 

গবেষণাভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, বুলিংয়ের শিকার শিশুরা সাধারণত দুটি ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়:

১।আত্মসম্মান এবং
২।  নিরাপত্তাবোধ।

একটি শিশুর আত্মবিশ্বাস যদি একটি ছোট গাছের মতো হয়, তবে বুলিং সেই গাছের চারপাশে জমে থাকা শুকনো মাটির মতো, যেখানে শেকড় ঠিকমতো বাড়তে পারে না।

 

বুলিংয়ের মুহূর্তগুলো শিশুর মস্তিষ্কে কী করে?

শিশুর মস্তিষ্ক তখনো গঠনের মধ্যে থাকে। সেই সময়ে পাওয়া বুলিংয়ের প্রতিটি অভিজ্ঞতা মস্তিষ্কের আবেগ ও স্মৃতি সংক্রান্ত এলাকায় ভয়ের সুর সেট করে দেয়। ফলে—

১. ভয়প্রবণতা তৈরি হয়। চাপের মুহূর্তে শরীরের “লড়াই বা পালিয়ে যাওয়া” সিস্টেম অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে পড়ে। ফলে ছোট্ট খোঁটা থেকেও শিশু বেশি ভয় পায়, সহজে কেঁদে ফেলে, এবং সময়ের সাথে ভয় যেন তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হয়ে যায়।

২. আত্মসম্মান ভেঙে পড়ে। যখন কাউকে বারবার বলা হয়-“তুই বাজে”, “তুই কিছু পারবি না”, তখন শিশুটি শুরু করে বিশ্বাস করতে, “হয়তো সত্যিই আমি খারাপ”। এই বিশ্বাস বড় হয়ে অনেককে পিছুটান দিয়ে রাখে।

৩. সামাজিক দক্ষতায় ঘাটতি তৈরি হয়। অন্যরা তাকে ভুল বুঝবে বা উপহাস করবে, এই ভয় তাকে সম্পর্ক গড়তে পিছিয়ে দেয়।

৪. মানসিক চাপ দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী হয়ে যায়। শৈশবের চাপ প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে উদ্বেগ, অস্থিরতা, অতিরিক্ত আত্মরক্ষা, বা অতিমাত্রায় সংবেদনশীল আচরণে রূপ নিতে পারে।
 

বড় হওয়ার পর এই ক্ষতগুলো যেভাবে প্রকাশ পায়-

শৈশবের বুলিংয়ের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী, গবেষক ও সংগঠনের পর্যবেক্ষণ এক সুরে বলে, এই ক্ষত কখনো কখনো মানুষকে এমনভাবে বদলে দেয়, যা বাইরে থেকে বোঝাই যায় না।

১. অত্যধিক আত্ম-সন্দেহ- যে শিশু সবসময় শুনেছে-“তুই দুর্বল”, “তুই ব্যর্থ” সে বড় হয়ে নিজের প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিধায় পড়ে। নতুন চাকরি, নতুন সম্পর্ক, নতুন সুযোগ প্রতিটা জায়গায় সে ভাবে, “আমি পারব তো?”

২. মানুষের সাথে দুরত্ব বজায় রাখা- শৈশবের অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে, মানুষ আঘাত করে।
ফলে সে নিরাপদ থাকতে ভবিষ্যৎ সম্পর্কগুলোতে দূরত্ব রাখে, ঘনিষ্ঠতা এড়িয়ে চলে।

৩. তুচ্ছ ঘটনাতেও অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া- একটি সাধারণ মন্তব্যকেও সে অপমান বা হুমকি হিসেবে নিতে পারে। এই বিষয়টি সম্পর্ক ও কর্মস্থলে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করে।

৪. অনুভূতি প্রকাশে অক্ষমতা- নিজের ভেতরের কষ্ট, ভয় বা অপমান নিয়ে কথা বলতে সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। ফলে চাপ জমতে থাকে।

৫. পরিপূর্ণতার প্রতি অতি-মগ্নতা- নিজেকে প্রমাণ করার তাড়নায় অনেক সময় সে অতিরিক্ত কঠোর হয়ে পড়ে, যা মানসিক ক্লান্তি বাড়ায়।

৬. বিষণ্নতা ও উদ্বেগের প্রবণতা- একাকীত্ব, ভয়, লজ্জা-এই তিনের মিশ্রণে অনেকের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে বিষণ্নতার লক্ষণ দেখা যেতে পারে।

 

সোশ্যাল মিডিয়া যুগে বুলিংয়ের ভয় আরও কীভাবে বাড়ছে?

আগে বুলিং ছিল স্কুল বা মাঠ সীমাবদ্ধ। এখন শিশুর ঘর পর্যন্ত তা ছড়িয়ে পড়ে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে। ডিজিটাল বুলিংয়ের সমস্যাগুলো হলো- এটি ২৪ ঘণ্টা ঘটতে পারে। বার্তা বা ছবি স্থায়ীভাবে থেকে যায়। উপহাস প্রায়ই অনেক মানুষের সামনে ভাইরাল হয়।। ভুক্তভোগী নিজের ঘরেও নিরাপদ মনে করতে পারে না। ফলে শিশুর মানসিক চাপ আরো জটিল হয়ে ওঠে।

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, শিশুরা বুলিংয়ের কথা বলতে চায় না। কারণ,তারা মনে করে কেউ বিশ্বাস করবে না। তারা ভাবে অভিযোগ করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। লজ্জা ও আত্মসম্মান ক্ষুন্ন হওয়ার ভয় থাকে।  অনেকে তাদের পরিবারকে দুঃশ্চিন্তায় ফেলতে চায় না। এই নীরবতার চাপই দীর্ঘমেয়াদে মানসিক সমস্যা বাড়ায়।

 

সমাধানের পথ কোথায়?

১. পরিবারকে হতে হবে প্রথম নিরাপদ জায়গা। শিশুটি যেন জানে—“আমি কথা বললে কেউ হাসবে না”—এই নিশ্চয়তা সবচেয়ে জরুরি।

২. শিক্ষক ও স্কুলের ভূমিকা! স্কুলে বুলিং নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা, বাচ্চাদের সহমর্মিতা শেখানো, এবং যেকোনো অপমানজনক আচরণের বিরোধিতা এসব মৌলিক পদক্ষেপ।

৩. শিশুকে আত্মবিশ্বাস শেখাতে হবে । নিজেকে ছোট ভাবলে বুলিংয়ের প্রভাব বেশি হয়। শিশুকে নিজের শক্তির জায়গা চেনাতে হবে- খেলা, আঁকা, গল্প বলা, যে কোনো দক্ষতা আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।

৪. আবেগ প্রকাশ শেখাতে হবে। শিশুকে বলা উচিত, মন খারাপ হলে বা কেউ কষ্ট দিলে তা বলা একদম ঠিক।

৫. প্রযুক্তি ব্যবহারে পর্যবেক্ষণ- শিশুর অনলাইন কার্যক্রম সম্পর্কে সজাগ থাকা এবং প্রয়োজনীয় সীমাবদ্ধতা তৈরি করা।
 

বড় হয়ে যাদের ভেতরে এখনো বুলিংয়ের ক্ষত আছে-তাদের করণীয় কী?

অনেক প্রাপ্তবয়স্ক নিজের অজান্তেই পুরনো ক্ষতের সাথে প্রতিদিন যুদ্ধ করে। তাদের জন্য কিছু পথ-

☞ নিজের অনুভূতি চিহ্নিত করা।

☞ অতীতকে অস্বীকার না করে গ্রহণ করা।

☞ নিরাপদ সম্পর্ক গড়ে তোলা।

☞ আত্মসম্মান বৃদ্ধির চর্চা।

☞ মানসিক চাপ কমানোর পদ্ধতি শেখা।

☞ প্রয়োজনে পেশাদার সহায়তা নেওয়া।

☞ শৈশবের কষ্টকে অস্বীকার করলে তা কমে না; বরং কথায়, বোঝায়, সম্মানজনক আচরণে তা ধীরে ধীরে নিরাময় হয়।

 

শৈশবের বুলিং কোনো সাধারণ অভিজ্ঞতা নয়। ছোট একটি অপমান, একটি ধাক্কা, একটি বিদ্রূপ শিশুর মনে এমনভাবে ছাপ রেখে যায় যা বড় হয়ে তার আচার-আচরণ, আত্মবিশ্বাস, স্বপ্ন, সম্পর্ক সবকিছুতেই প্রভাব ফেলে। অথচ এই সমস্যার সমাধান বড় কোনো অস্ত্র নয়—সহমর্মিতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ। একটি শিশুর হাসি যেন তার অধিকার হয়, ভয়ের বিষয় না। এই নিশ্চয়তা নিশ্চিত করাই আমাদের কাজ। সমাজ যদি চায় সুস্থ প্রজন্ম, তবে বুলিংকে মজার ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ, একটি ছোট কষ্টও বড় জীবনের অনেক সিদ্ধান্ত বদলে দিতে পারে।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ