বন্ধুর সাথে শেখা মানেই দ্রুত শেখা-এটা কি সত্যিই বিজ্ঞানসম্মত? নতুন গবেষণায় মিলল ইঙ্গিত!

বন্ধুর সাথে শেখা মানেই দ্রুত শেখা-এটা কি সত্যিই বিজ্ঞানসম্মত? নতুন গবেষণায় মিলল ইঙ্গিত!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

শিক্ষার জগতে আমরা প্রায়ই শুনি-“বন্ধুকে বুঝিয়ে বললে বিষয়টা মাথায় সবচেয়ে বেশি থাকে।” দীর্ঘদিন ধরে এটিকে বলা হতো সাধারণ জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার সত্য। কিন্তু আজকের নিউরোসায়েন্স বলছে, এটি শুধুই অভিজ্ঞতা নয়, বরং একটি বৈজ্ঞানিক সত্য। বন্ধুর সঙ্গে পড়া, আলাপ করা, সমস্যা বোঝা কিংবা একে অপরকে বুঝিয়ে বলার মতো প্রক্রিয়াগুলো আসলে মস্তিষ্কে এমনভাবে প্রভাব ফেলে যে শেখা বিষয়গুলো দীর্ঘ সময় টিকে থাকে, আরও গভীরভাবে সংরক্ষিত হয় এবং প্রয়োগযোগ্য হয়ে উঠে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় Peer Learning বা সহপাঠ শেখা। এটি শুধু পরীক্ষায় ভালো ফলের থিওরি নয়; বরং মস্তিষ্কের জটিল নিউরাল নেটওয়ার্ক, সামাজিক আচরণ, আবেগীয় নিরাপত্তা এবং স্মৃতি গঠনের পুরো কাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কিত।

মানুষ মূলত সামাজিক জীব। শেখার ক্ষেত্রেও তার মস্তিষ্ক সামাজিক আচরণকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়।
যখন কেউ বন্ধুর সাথে বসে কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করে, প্রশ্ন করে বা কাউকে বুঝিয়ে বলে, তখন মস্তিষ্কে তিন ধরনের বড় পরিবর্তন ঘটে- 

১. Social Engagement System সক্রিয় হয়। বন্ধুর মুখভঙ্গি, হাতের ইশারা, চোখের দৃষ্টি, হাসা–মুখভাঁজ মস্তিষ্কের সোশ্যাল প্রসেসিং নেটওয়ার্ক সক্রিয় করে। এতে মস্তিষ্ক শেখাকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হিসেবে রেকর্ড করে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মানুষের দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী ফরম্যাট।

২. Mirror Neurons কাজ করে। অন্যকে দেখে শেখা, নিষ্ক্রিয় ব্যাপার নয়। বরং মস্তিষ্কের মিরর নিউরোন নামের বিশেষ কোষগুলো অন্যের আচরণ দেখে নিজেকে সেই অভিজ্ঞতার ভিতরে নিয়ে যায়। বন্ধুকে সমস্যার সমাধান করতে দেখতে দেখতে, নিজের মস্তিষ্কও ঠিক সেই গাণিতিক ধাপ বা যুক্তিগুলোকে অভ্যন্তরীণভাবে পুনরায় অভিনয় করে। এই পুনরাবৃত্তি স্মৃতি টিকিয়ে রাখার অন্যতম প্রধান উপাদান।

৩. Reward Circuit সক্রিয় হয়। বন্ধুকে কিছু বুঝাতে পারলে, সে “আহা বুঝলাম!” বললেই আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসরণ হয়। এটি শেখাকে করে তোলে আনন্দদায়ক। আর আনন্দ–কেন্দ্রিক শেখা মস্তিষ্ক সবচেয়ে দ্রুত এবং দীর্ঘমেয়াদি আকারে গ্রহণ করে।

 

বন্ধুর সাথে শেখা কেন বই বা ক্লাস লেকচারের তুলনায় বেশি টেকসই?

১. সক্রিয় শেখা (Active Learning) ঘটে। ক্লাসে আমরা প্রায়ই নিষ্ক্রিয়, শুধু শুনছি। কিন্তু পিয়ার লার্নিংয়ে প্রশ্ন করতে হয় উত্তর খুঁজতে হয়, ব্যাখ্যা দিতে হয়, ভুল সংশোধন করতে হয়, উদাহরণ দিতে হয়। এই অ্যাক্টিভ এনগেজমেন্ট স্মৃতিকে মস্তিষ্কের গভীর স্তরে গেঁথে রাখে।

 

২. চাপহীন পরিবেশ স্মৃতিকে স্থায়ী করে।শিক্ষক–শিক্ষার্থীর সম্পর্ক অনেক সময়েই আনুষ্ঠানিক থাকে। ভয়, সংকোচ, ভুল করলে বকা খাওয়ার ভয়  লার্নিং ব্লক করে। বন্ধুর সঙ্গে শেখা এই মানসিক চাপকে কমায়।চাপ কমলে ফোকাস বাড়ে, মস্তিষ্ক তথ্য খুলে গ্রহণ করে, শেখার টোন ইতিবাচক হয়, স্ট্রেস কমলে হিপোক্যাম্পাস ভালোভাবে কাজ করে, যা দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতি সংরক্ষণের প্রধান স্টোরহাউস।

 

৩. ভাষা সহজ হয়, ব্যাখ্যা বাস্তব হয়। বন্ধুরা আমাদের মতো একই ভাষায় কথা বলে। তারা জটিল তত্ত্বকে সহজভাবে বলে, “দেখ, ব্যাপারটা এমন...”“ধর এই উদাহরণটা...”“এভাবে মনে রাখ…”

এগুলোর ফলে মস্তিষ্ক বিষয়টিকে ধারণাগতভাবে বুঝে নেয়, মুখস্থ নয়।

 

৪. ব্যাখ্যা দিতে গেলে শেখা আরও গভীর হয়।কাউকে বোঝানো হলো শেখার সর্বোচ্চ স্তর। কারণ বোঝাতে গেলে নিজের বোঝা পরিষ্কার করতে হয়, ভুল বুঝলে তাতেই ধরা পড়ে, তথ্য পুনরায় সংগঠিত করতে হয়। এতে নিউরাল কানেকশন শক্তিশালী হয়।যে বিষয়টি নিজের মস্তিষ্ক পুনরায় সাজায়, তা দীর্ঘসময় টিকে থাকে।

 

পিয়ার লার্নিং যেভাবে প্রভাব ফেলে-

মানুষ যখন কিছু শেখে, তখন স্মৃতি তিন ধাপ অতিক্রম করে-

☞  Encoding

☞ Consolidation

☞  Retrieval
 

বন্ধুর সাথে শেখার ভিতরে এই তিন ধাপই শক্তিশালীভাবে সক্রিয় হয়।
 

Encoding (তথ্য প্রথমবার গ্রহণ) তে আলোচনা, প্রশ্ন, হাসি-আনন্দ-এই তিন উপাদান এনকোডিংকে শক্তিশালী করে। আর Consolidation (তথ্য দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিতে স্থান পাওয়া)তে, বন্ধুর সঙ্গে শেখা পুনরাবৃত্তি বাড়ায়। একজন প্রশ্ন করে, অন্যজন উত্তর দেয়, এই  কথোপকথন স্মৃতি স্থায়ী করে। আবার Retrieval (প্রয়োজনে মনে পড়া),

বন্ধুর সঙ্গে শেখা স্মৃতির মধ্যে একধরনের ‘সিচুয়েশনাল ইনডেক্স’ তৈরি করে। পরীক্ষায় মনে পড়ে- “ওইদিন রুমে বসে কথা বলার সময়...” “ওই প্রশ্নটা অমুক বলেছিল...”।এটি স্মৃতি ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া দ্রুত করে।

 

নতুন গবেষণা বলছে, পিয়ার লার্নিং  শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য নয়। সহকর্মীর কাছ থেকে শেখাও equally effective। যেমন-

⇨ অফিসের ফিডব্যাক

⇨ সহকর্মীর প্রজেক্ট ব্যাখ্যা

⇨ দলীয় আলোচনা

⇨ ব্রেইনস্টর্মিং

 

প্রতিটি জায়গায় একই মস্তিষ্কীয় প্রক্রিয়া কাজ করে।যেসব প্রতিষ্ঠান কর্মীদের দলগত শেখার সুযোগ দেয়, তাদের উৎপাদনশীলতা, সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে।
 

বন্ধু বা সমসাময়িক কারও সাথে শেখা আরও এক দিক দিয়ে শক্তিশালী-মানসিক নিরাপত্তা।
এটি এমন একটি অনুভূতি যেখানে-

◑ ভুল করলে হাসাহাসি হবে না।

◑ প্রশ্ন করলেই কেউ বিচার করবে না।

◑ অজ্ঞতা দেখালেও অপমান হবে না।

◑ মস্তিষ্ক নিরাপদ অনুভব করলে শেখার পথ খুলে যায়। অন্যদিকে ভয় বা লজ্জা থাকলে মস্তিষ্ক ডিফেন্স মোডে চলে যায়, যেখানে শেখা প্রায় অসম্ভব।

 

বন্ধুর সঙ্গে শেখার সময় মস্তিষ্কে তিনটি প্রধান নিউরোকেমিক্যাল বাড়ে-

১. ডোপামিন - শেখাকে আনন্দদায়ক করে। রিওয়ার্ড ফিলিং বাড়ে ফলে স্মৃতি দীর্ঘস্থায়ী হয়।

২. অক্সিটোসিন - বিশ্বাস ও বন্ধন বাড়ায়। বন্ধুর কাছ থেকে শেখা কেন নিরাপদ মনে হয় তার পেছনে অক্সিটোসিনের ভূমিকা বিশাল।

৩. সেরোটোনিন - ফোকাস ধরে রাখে। সঠিক মানসিক অবস্থা শেখাকে স্থিতিশীল করে।এগুলো মিলেই পিয়ার লার্নিংকে নিউরোকেমিক্যালি স্মার্ট লার্নিং বলে ধরা হয়।
 

মানুষের বিবর্তন বলছে, সহযোগিতা ছাড়া টিকে থাকা অসম্ভব। মানুষ কখনো একা শিখেনি;
সবসময়ই আগুন জ্বালানো, ফল শনাক্ত, শিকার কৌশল, ভাষা, শিল্প, সমাজ সবকিছুই শিখেছে অন্য মানুষের আচরণ দেখে, শুনে, ব্যাখ্যা করে। পিয়ার লার্নিং তাই আধুনিক কোনো পদ্ধতি নয়। এটি মানুষের বিবর্তনের সবচেয়ে পুরোনো এবং সবচেয়ে কার্যকর শেখার মাধ্যম।
 

পিয়ার লার্নিং কেন ভবিষ্যতের শিক্ষার প্রধান ভিত্তি হতে পারে?

প্রযুক্তি যতই বাড়ুক, এআই যতই শক্তিশালী হোক আর ভার্চুয়াল ক্লাস যতই বিস্তৃত হোক না কেন মানুষ এখনও মানুষের কাছ থেকেই সবচেয়ে টেকসইভাবে শেখে। কারণ, এটাই তার জৈবিক স্বভাব।

পিয়ার লার্নিং কোনো সাধারণ বিষয় নয়। এটি মানুষের মস্তিষ্কের গভীর কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত একটি স্বাভাবিক শেখার পদ্ধতি। বন্ধুর সঙ্গে শেখা আমাদের মধ্যে আনন্দ সৃষ্টি করে, চাপ কমায়, ব্যাখ্যাকে সহজ করে, স্মৃতিকে দীর্ঘমেয়াদি করে, আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং শেখাকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগযোগ্য করে তোলে।অতএব এটা শুধু বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটানো নয়, এটি শেখার সবচেয়ে মানবিক  উপায়। বন্ধু আপনাকে শুধু সঙ্গ দেয় না,বরং আপনার মস্তিষ্কের গভীরে শেখার নতুন রাস্তা খুলে দেয়।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ