ক্ষুদ্র দেহে লুকিয়ে ভয়ঙ্কর বিপদ ; পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত অক্টোপাস!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
-
সমুদ্রের নীল পানিতে কখনো কখনো এমন কিছু সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে, যা এক নজরেই আমাদেরকে মুগ্ধ করে তোলে। কিন্তু অনেক সময় এই মুগ্ধতা অজান্তেই মৃত্যু ডেকে আনে। অস্ট্রেলিয়ার উপকূলীয় পানিতে পাওয়া ব্লু-রিং অক্টোপাস ঠিক তেমনই এক বিস্ময়কর এবং আতঙ্কজনক প্রাণী। এটি আকারে হয় মানুষের তালুর চেয়েও ছোট, রঙে শান্ত ও আকর্ষণীয়। কিন্তু এর শরীরের ভেতর লুকিয়ে আছে এমন এক বিষ, যা কয়েক মিনিটেই মানুষের শ্বাস থামিয়ে দিতে পারে। প্রাণীবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটি শুধু একটি সামুদ্রিক অক্টোপাসই নয়, প্রাকৃতিক বিষের এক জীবন্ত পরীক্ষাগারই বটে। এই প্রাণীকে দেখলে বোঝা যায় প্রকৃতির ভয়ংকর বিষয়গুলো সব সময় আকারে বড় হয় না, কখনো কখনো লুকিয়ে থাকে সবচেয়ে ছোট শরীরের ভেতর।
ব্লু-রিং অক্টোপাস সাধারণত ১২ থেকে ২০ সেন্টিমিটারের বেশি বড় হয় না। সমুদ্রতটে হাঁটতে গিয়ে কেউ যদি হঠাৎ এর দেখা পায়, প্রথমে সেটিকে নিরীহই মনে হবে। শরীরের মূল রঙ হালকা বাদামি বা হলদেটে, কিন্তু বিপদের সময় এর শরীরে ফুটে ওঠে উজ্জ্বল নীল বৃত্ত, যা এক ধরনের প্রাকৃতিক সতর্ক সংকেত। এই নীল রং এর বৃত্তগুলো শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়। এগুলো প্রকৃতির ভাষায় এক ভয়ংকর বার্তা। শিকারী বা মানুষের জন্য এটি শেষ সতর্কতা। কারণ এই প্রাণীটি কামড়ালে, বিষ প্রবেশ করে মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে এমনভাবে কাজ শুরু করে যে মুহূর্তের মধ্যেই শরীর অসাড় হয়ে যেতে পারে।
ব্লু-রিং অক্টোপাসের বিষের প্রধান উপাদান হলো টেট্রোডোটক্সিন। এটি এমন এক স্নায়ুবিষ, যা স্নায়ু ও পেশির মধ্যে সংকেত আদান-প্রদান বন্ধ করে দেয়। যার ফলে ধীরে ধীরে আক্রান্ত ব্যক্তির কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়, নড়াচড়া করতে পারে না, এমনকি শ্বাস নিতেও অক্ষম হয়ে পড়ে। সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হলো- এই বিষের কোনো প্রতিষেধক নেই। চিকিৎসা বলতে শুধুমাত্র কৃত্রিমভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস চালু রাখা এবং শরীরকে সময় দেওয়া - এতটুকুই করা যায়, যাতে বিষ ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়। কিন্তু সেই সময়টুকু পার করা বেশিরভাগ সময়ই সম্ভব হয় না। একটি ছোট্ট অক্টোপাসের শরীরে থাকা বিষের পরিমাণ এতটাই শক্তিশালী যে তা একাধিক পূর্ণবয়স্ক মানুষকে হত্যা করার ক্ষমতা রাখে। এ কথা প্রাণীবিজ্ঞানে বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে ভেবেছেন, এই অক্টোপাস নিজেই কি নিজের শরীরে বিষ তৈরি করতে পারে কি না! পরবর্তীতে জানা যায়,এই বিষের উৎস আরও রহস্যময়! ব্লু-রিং অক্টোপাসের শরীরের ভেতরে থাকা কিছু বিশেষ ব্যাকটেরিয়া এই টেট্রোডোটক্সিন তৈরি করতে সক্ষম। অক্টোপাস সেই বিষ নিজের গ্রন্থিতে জমা রাখে এবং প্রয়োজনে ব্যবহার করে।
এটি প্রকৃতির এক অদ্ভুত সহাবস্থানের উদাহরণ।এখানে ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া ও সামুদ্রিক প্রাণী একসাথে কাজ করে এক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, যা সমুদ্রের খাদ্যশৃঙ্খলে তাদের টিকে থাকার নিশ্চয়তা দেয়।
ব্লু-রিং অক্টোপাস খুব বেশি দ্রুত সাঁতার কাটতে পারে না। বড় শিকারীর কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগও সীমিত। তাই তো প্রকৃতি তাকে দিয়েছে ভিন্ন এক অস্ত্র আর তা হলো তার সেই ভয়ংকর বিষ। এই বিষ শুধুমাত্র তার আত্মরক্ষার জন্য না, শিকার ধরার কাজেও সে এটি ব্যবহার করে । ছোট মাছ বা চিংড়িকে কামড়ালে বিষ মুহূর্তে তাদের পেশি অবশ করে দেয়। ফলে শিকার পালানোর সুযোগ পায় না।
তাই বলাই যায়, এই অক্টোপাসের কাছে বিষ মানেই তার জীবনধারণের প্রধান হাতিয়ার।
এ অক্টোপাস মূলত অস্ট্রেলিয়ার উপকূলীয় পানি, প্রবালপ্রাচীর ও অগভীর সমুদ্রে বেশি দেখা যায়। এটি জোয়ার-ভাটার সময় পাথরের নিচে বা শামুকের খোলসেও লুকিয়ে থাকে কখনো কখনো। এর জন্য, সাঁতারু বা সমুদ্রতটে হাঁটতে আসা মানুষের জন্য এখানে মারাত্মক বিপদের সম্ভাবনা থাকে। অনেক সময় মানুষ কৌতূহলবশত এই সুন্দর প্রাণীটিকে হাতে তুলে নেয় নিয়ে ছবি তোলে, কেউবা কাছ থেকে দেখতে চায়! বিপদ ঘটে সেখানেই । যদিও এই অক্টোপাস সাধারণত আক্রমণাত্মক হয় না, তবে ভয় পেলে বা চাপে পড়লে কামড়াতেই পারে। আর সেই কামড় বেশিরভাগ সময় ব্যথাহীন হয়। ফলে মানুষ শুরুতে বুঝতেই পারে না যে বিষ শরীরে প্রবেশ করেছে ।
বিষক্রিয়ার প্রথম লক্ষণগুলো হয় খুবই সূক্ষ্ম-
⇨ ঠোঁট ও মুখের চারপাশ ঝিনঝিন করা,
⇨ শরীর ভারী লাগা,
⇨ কথা জড়িয়ে আসা
এই লক্ষণগুলো দিয়েই শুরু হয়। এরপর আস্তে আস্তে পেশি অবশ হয়ে যায়, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
অনেক সময় আক্রান্ত ব্যক্তিটি পুরোপুরি সচেতন থাকেন, কিন্তু শরীর নড়াতে বা কথা বলতে পারেন না। বাইরে থেকে মনে হতে পারে সে অচেতন, কিন্তু ভেতরে সে সবকিছু অনুভব করছে। এই অভিজ্ঞতাকে অনেকেই জীবন্ত বন্দিত্ব বলে বর্ণনা করেন।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা-
ব্লু-রিং অক্টোপাসের বিষের কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষেধক নেই। আর তাই চিকিৎসাবিজ্ঞান এখানে অনেকটাই অসহায়। দ্রুতভাবে হাসপাতালে যেয়ে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস চালু করা ছাড়া আর কোনো কার্যকর পদ্ধতি নেই। এই বাস্তবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রযুক্তি এবং আধুনিক চিকিৎসা যতই উন্নত হোক না কেন, প্রকৃতির নিজস্ব কিছু অস্ত্র কিন্তু এখনও মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরেই রয়ে গেছে ।
ব্লু-রিং অক্টোপাস প্রকৃতির একটি দ্বৈত চরিত্রের প্রতীক। একদিকে এটি অসাধারণ সুন্দর, অন্যদিকে আবার মারাত্মক প্রাণঘাতীও বটে। আমাদের সকলেরই তাই ভুলে গেলে চলবে না যে, সৌন্দর্যের আড়ালেও বিপদ থাকতে পারে। প্রকৃতিকে অবহেলা করলে তার মূল্য চুকাতে হবে। সমুদ্র মানে শুধু নীল পানি আর রোদেলা ছুটি নয়, সেখানে রয়েছে নানা রকমের শক্তিশালী প্রাণ, যাদের রয়েছে বৈচিত্র্যময় নিজস্ব নিয়ম।
তবে ব্লু-রিং অক্টোপাস কিন্তু মানুষকে আক্রমণ করতে চায় না। সে চায় নিজের মতো করে বেঁচে থাকতে। সমস্যাটা তৈরি হয় তখনই, যখন আমরা মানুষরা, আমাদের অজ্ঞানতাবশত বা কৌতূহল থেকে তার সীমানায় হস্তক্ষেপ করে ফেলি। সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো তাই অত্যন্ত জরুরি। কোন প্রাণীকে ছোঁয়া যাবে না, কোনটিকে দূর থেকে দেখাই নিরাপদ- এই জ্ঞানই আমাদের অজ্ঞানতা দূর করতে পারে এবং জীবন বাঁচাতে পারে।
প্রকৃতিতে শক্তির মাপ সব সময় চোখে দেখা যায় না। কখনো সবচেয়ে ছোট প্রাণীই হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে। এই অক্টোপাস কেবল কিন্তু একটি বিষাক্ত প্রাণী নয়, এটি প্রকৃতির তরফ থেকে দেওয়া এক সতর্ক সংকেত। প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানে থাকতে হলে তাই আমাদের জানতে হবে, বুঝতে হবে, আর সম্মান করতে হবে প্রকৃতির সকল নিয়ম। নীল বৃত্তের সেই ঝলকানি তাই শুধু ভয়ই না, এটি বাঁচার শেষ ইঙ্গিত।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।