মহাবিশ্বের গভীর অন্ধকারের চিৎকার এর রহস্য কি! জানেন?

মহাবিশ্বের গভীর অন্ধকারের চিৎকার এর রহস্য কি! জানেন?
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

" মহাবিশ্ব নীরব"- এই ধারণা বহুদিন ধরেই মানুষের মনে গেঁথে ছিল। কিন্তু গত এক দশকে সেই নীরবতার বুক চিরে উঠে এসেছে কিছু অতি ক্ষণস্থায়ী, অথচ অসম্ভব শক্তিশালী সংকেত। সময় মাত্র মিলিসেকেন্ড, কিন্তু শক্তিতে পুরো একটি গ্যালাক্সির রেডিও বিকিরণকেও হার মানাতে পারে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় এগুলোকে বলে ফাস্ট রেডিও বার্স্ট,সংক্ষেপে এফআরবি। তবে মনে প্রশ্ন জাগে- এই অচেনা সংকেতের উৎসটা কী? প্রাকৃতিক মহাজাগতিক বিস্ফোরণ, নাকি মহাবিশ্বের গভীরে লুকিয়ে থাকা আরও জটিল কোনো প্রক্রিয়া!

প্রথমবারের মতো ২০০৭ সালে একটি রেডিও টেলিস্কোপের তথ্য বিশ্লেষণে ধরা পড়ে অস্বাভাবিক এক ঝলকানি। শুরুতে বিজ্ঞানীরাই ভেবেছিলেন, হয়তো কোনো যন্ত্রগত ত্রুটি! কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোতে একের পর এক একই ধরনের সংকেত ধরা পড়তে থাকে। তখনই স্পষ্ট হয়, বিষয়টি কোনো কাকতালীয় কিছু নয়। এই সংকেতগুলো আসে পৃথিবীর বাইরে বহু দূরের গ্যালাক্সি থেকে। এত দূরত্ব পেরিয়ে আসার পরও এদের শক্তি এত প্রবল যে আধুনিক রেডিও টেলিস্কোপে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। সময় এত কম যে চোখের পলক ফেলার আগেই মিলিয়ে যায়, অথচ তার ভেতরে লুকিয়ে থাকে বিস্ময়কর তথ্য।

 

কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এই এফআরবি?

ফাস্ট রেডিও বার্স্ট শুধু রহস্যময় বলেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এগুলো মহাবিশ্ব বোঝার নতুন জানালা খুলে দেয়। এই সংকেত যখন কোটি কোটি আলোকবর্ষ পাড়ি দেয়, তখন পথে থাকা গ্যাস, ধূলিকণা ও অদৃশ্য কণার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। সেই যাত্রাপথের ছাপ আবার সংকেতের ভেতর থেকে যায়। ফলে বিজ্ঞানীরা এই তথ্য ব্যবহার করে জানতে পারেন - মহাবিশ্বে কী পরিমাণ বস্তু ছড়িয়ে আছে, কোথায় কতটা ঘনত্ব, এমনকি সেই ‘হারিয়ে যাওয়া বস্তু’ যা তাত্ত্বিকভাবে থাকার কথা ছিল কিন্তু দেখা যাচ্ছিল না। সহজভাবে বলা যায়, এফআরবি হলো মহাবিশ্বের এক ধরনের প্রাকৃতিক স্ক্যানার।

গবেষণার শুরুতে ধারণা ছিল, সব এফআরবি হয়তো একবারই ঘটে, কোনো ভয়াবহ বিস্ফোরণের ফল। কিন্তু পরে দেখা যায়, কিছু সংকেত একই উৎস থেকে বারবার আসছে।এই আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের ভাবনাকে নতুন দিকে নিয়ে যায়।

এককালীন এফআরবি হলে সেটি হতে পারে কোনো বিশাল নক্ষত্রের মৃত্যু, নিউট্রন নক্ষত্রের সংঘর্ষ বা অন্য কোনো চূড়ান্ত ঘটনা। কিন্তু বারবার ফিরে আসা সংকেতের ক্ষেত্রে উৎসকে টিকে থাকতে হয়। ফলে সেখানে এমন কোনো মহাজাগতিক বস্তু দরকার, যা দীর্ঘ সময় ধরে শক্তি নিঃসরণ করতে পারে।

বর্তমানে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাগুলোর একটি হলো, ম্যাগনেটার। ম্যাগনেটার হচ্ছে নিউট্রন নক্ষত্রের এক বিশেষ রূপ, যাদের চৌম্বক ক্ষেত্র এত শক্তিশালী যে পৃথিবীর সব চৌম্বক ক্ষেত্র মিলিয়েও তার ধারে-কাছেও যায় না। এই অতি শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র মাঝে মাঝে হঠাৎ ভেঙে পড়ে বা পুনর্বিন্যাস ঘটে। সেই মুহূর্তে বিপুল পরিমাণ শক্তি রেডিও তরঙ্গ হিসেবে বেরিয়ে আসতে পারে।বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন, আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সিতেও এক ম্যাগনেটার থেকে এফআরবি-সদৃশ সংকেত ধরা পড়েছে। এই ঘটনাটি ম্যাগনেটার তত্ত্বকে শক্ত ভিত্তি দেয়। কিন্তু  সব এফআরবি কি ম্যাগনেটার থেকেই আসে? এখানেই গল্পটা জটিলহতে শুরু করে।

মহাবিশ্ব একরৈখিক নয়। বিজ্ঞানীরা এখন মনে করছেন, এফআরবি হয়তো একক কোনো ঘটনার ফল নয়।কিছু সংকেত আসতে পারে ম্যাগনেটার থেকে, কিছু আসতে পারে ব্ল্যাক হোলের আশপাশের অশান্ত পরিবেশ থেকে, আবার কিছু হয়তো দুই ঘন নক্ষত্রের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ফলও হতে পারে।এই ধারণাটি বিজ্ঞানকে আরও বাস্তবসম্মত করে তোলে। যেমন পৃথিবীতে সব বজ্রপাত একই কারণে হয় না, তেমনি মহাবিশ্বেও সব এফআরবির উৎস এক নয়। এটা এখন অনেক গবেষকেরই অভিমত।

গণমাধ্যমগুলোতে প্রায়ই শোনা যায়-“এফআরবির রহস্য সমাধান হয়ে গেছে।” কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায় সমাধান মানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়।বিজ্ঞানীরা এখন আরও সূক্ষ্ম প্রশ্ন তুলছেন—
এই সংকেতগুলোর শক্তি ঠিক কীভাবে তৈরি হয়?কেন কিছু এফআরবি নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে আসে, আবার কিছু পুরোপুরি অনিয়মিত?এগুলো কি আশপাশের পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনো গবেষণার পথে।

নতুন প্রজন্মের রেডিও টেলিস্কোপ এফআরবি গবেষণাকে দিয়েছে নতুন গতি । এখন একই সঙ্গে আকাশের বিশাল অংশ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে আগের চেয়ে অনেক বেশি সংকেত ধরা পড়ছে, এবং  উৎস দ্রুত শনাক্ত করা যাচ্ছে। এর ফলে বিজ্ঞানীরা শুধু এফআরবি নয়, মহাবিশ্বের গঠন, অদৃশ্য বস্তু এবং দূরবর্তী গ্যালাক্সির পরিবেশ সম্পর্কেও নতুন তথ্য পাচ্ছেন। একসময় যাকে নিছক কৌতূহলের বিষয় মনে করা হয়েছিল, সেটাই এখন মহাজাগতিক গবেষণার অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার।

মহাবিশ্ব যতটা বিশাল,ঠিক ততটাই জটিল। তবে এফআরবির রহস্য অনেকটাই উন্মোচিত হয়েছে। ম্যাগনেটারসহ কয়েকটি সম্ভাব্য উৎস চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু এই সংকেতগুলো এখনো আমাদের সামনে মহাবিশ্বের অজানা অধ্যায়গুলো উন্মুক্ত করতে পারেনি। হয়তো ভবিষ্যতে, আরও উন্নত প্রযুক্তি আর গভীর গবেষণার মাধ্যমে, এই ক্ষণিকের রেডিও ঝলকানিগুলো আমাদের জানাবে,মহাবিশ্ব শুধু নীরব নয়, বরং নিজের ভাষায় আমাদের সঙ্গে কথা বলছে। আর ফাস্ট রেডিও বার্স্ট সেই ভাষারই এক ক্ষুদ্র এবং  শক্তিশালী উচ্চারণ।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ