ঝাঁঝালো শোর্ষে রুই রেসিপি, স্বাদকে বাড়াবে দ্বিগুণ!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
-
বাংলার রান্নাঘরে এমন কিছু পদ আছে, যেগুলো স্বাদের পাশাপাশি সংস্কৃতি, পুষ্টিবিজ্ঞান ও স্মৃতির গভীর স্তরেও জায়গা করে নেয়। শোর্ষে রুই ঠিক তেমনই একটি নাম। একদিকে এর ঝাঁঝালো সুবাস আর সরিষার তেলের তীক্ষ্ণ গন্ধ, অন্যদিকে হার্টের জন্য উপকারী চর্বি ও মানসম্মত প্রোটিনের সমন্বিত এই পদটি আজ আধুনিক পুষ্টি–চিন্তার আলোচনাতেও জায়গা করে নিচ্ছে। বাংলাদেশের নদীমাতৃক ভূগোল যেমন রুই মাছকে জনপ্রিয় করেছে, তেমনি সরিষা ও সরিষার তেলকে করেছে দৈনন্দিন রান্নার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রুই মাছ বহু প্রজন্ম ধরেই বাঙালির প্রধান আমিষ উৎস। এর মাংস নরম, আঁশ তুলনামূলক কম এবং হজমযোগ্য। পুষ্টিবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রুই মাছ উচ্চমানের প্রোটিন সরবরাহ করে, যা শরীরের কোষ গঠন, পেশি মেরামত ও রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া রুই মাছে থাকে প্রয়োজনীয় কিছু খনিজ উপাদান ও ভিটামিন, যা দৈনন্দিন শারীরিক কার্যক্রমে সহায়ক। বিশেষ করে যারা লাল মাংস কম খান, তাদের জন্য রুই মাছ একটি ভারসাম্যপূর্ণ আমিষ বিকল্প।
সরিষা বাঙালি রান্নায় শুধু মসলা নয়, বরং স্বতন্ত্র এক চরিত্র। সরিষার দানায় থাকা প্রাকৃতিক যৌগ রান্নায় তীব্রতা ও স্বাদ যোগ করে। সরিষার তেলে থাকা কিছু উপকারী ফ্যাট শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিডের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। আধুনিক পুষ্টি–ভাবনায় সরিষার তেলকে মাঝারি পরিমাণে ব্যবহারের ক্ষেত্রে হৃদয়বান্ধব হিসেবে দেখা হয়, কারণ এটি রান্নায় তাপ সহনশীল এবং অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত তেলের মতো নয়। শোর্ষে রুইয়ের ক্ষেত্রে এই তেল শুধু স্বাদ নয়, মাছের প্রোটিনের সঙ্গে একটি পুষ্টিসম্পন্ন ভারসাম্যও তৈরি করে।
শোর্ষে রুইয়ের মূল আকর্ষণ এর সরলতায়। উপকরণ কম, কিন্তু স্বাদ খুব গভীর। এই পদে সরিষা বাটা ও কাঁচা মরিচের ঝাঁজ রুই মাছের স্বাদকে আরও উন্মুক্ত করে। রান্নার সময় সরিষার তেলের সুবাস যখন উঠতে থাকে, তখন তা ক্ষুধা জ্বালা বাড়ায়,যা স্মৃতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে এক ধরনের আবেগী সংযোগ তৈরি করে। খাদ্যবিজ্ঞানীরা বলেন, প্রোটিন ও ফ্যাটের সঠিক সংমিশ্রণ খাবারকে বেশি তৃপ্তিদায়ক করে। শোর্ষে রুই ঠিক সেই জায়গাতেই আলাদা। এটি পেট ভরায়, কিন্তু ভারী অনুভূতি তৈরি করে না।
রেসিপি:
শোর্ষে রুই রান্না করতে আলাদা কোনো জটিলতার প্রয়োজন নেই। বরং সঠিক উপকরণ আর ধৈর্যই এখানে আসল।
প্রথমে টাটকা রুই মাছের টুকরো পরিষ্কার করে ধুয়ে নিতে হয়। হালকা লবণ ও সামান্য হলুদ মাখিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিলে মাছের কাঁচা গন্ধ কমে আসে। এরপর সরিষার দানা ভিজিয়ে বেটে নিতে হয়। বাটার সময় অল্প কাঁচা মরিচ দিলে স্বাদে ঝাঁঝ আসে, কিন্তু তিক্ততা বাড়ে না। কড়াইয়ে পরিমাণমতো সরিষার তেল গরম করে নিতে হয়। তেল ঠিকমতো গরম হলে হালকা আঁচে মাছগুলো অল্প ভেজে তুলে রাখা যায়। এরপর সেই তেলেই সরিষা বাটা, লবণ ও সামান্য হলুদ দিয়ে কষাতে হয়। কষানো ঠিকমতো হলে তেলের উপরিভাগে সরিষার সুবাস ভেসে ওঠে। তখন মাছের টুকরো ও পরিমাণমতো পানি দিয়ে ঢেকে রান্না করতে হয়। খুব বেশি সময় নয়, মাছ সেদ্ধ হলেই নামাতে হয়। শেষে কয়েক ফোঁটা কাঁচা সরিষার তেল ছড়িয়ে দিলে স্বাদ ও গন্ধ সম্পূর্ণতা পায়।
শোর্ষে রুই একদিকে ভাতের সঙ্গে অসাধারণ, অন্যদিকে অতিরিক্ত ঝাল বা মসলাদার না হওয়ায় নিয়মিত খাওয়ার উপযোগী।পরিমিত তেল, টাটকা মাছ ও কম মসলা এই নীতিতে রান্না করলে শোর্ষে রুই একটি হালকা কিন্তু পুষ্টিকর খাবারে পরিণত হয়।
বাংলাদেশে শোর্ষে রুই কেবল দুপুরের খাবার নয়, এটি গ্রামবাংলার আতিথেয়তা, শহুরে নস্টালজিয়া আর পারিবারিক টেবিলের গল্প। অনেকের কাছে এটি শৈশবের স্মৃতি- মায়ের রান্না, দুপুরের রোদ, ভাতের গন্ধ। এই আবেগী দিকটিও খাবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আজকের দ্রুতগতির জীবনে সহজ কিন্তু পুষ্টিকর খাবারের চাহিদা বাড়ছে। শোর্ষে রুই সেই চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। এটি ঘরে রান্না করা যায়, উপকরণ সহজলভ্য, আর স্বাদে কখনো একঘেয়ে লাগে না। একই সঙ্গে এটি আমাদের খাদ্যসংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখারও একটি মাধ্যম। বিদেশি বা অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবারের ভিড়ে শোর্ষে রুই মনে করিয়ে দেয়- স্থানীয় উপকরণ ও ঐতিহ্যবাহী রান্নাই হতে পারে সুস্থ জীবনের ভিত্তি।
শোর্ষে রুই শুধু একটি রেসিপি নয়, এটি বাঙালির খাদ্যচিন্তার প্রতিচ্ছবি। সরিষার তেলের ঝাঁঝ, রুই মাছের নরম মাংস আর ঘরোয়া রান্নার সরলতা—এই তিনের মিলনে তৈরি হয় এমন একটি পদ, যা স্বাদ ও স্বাস্থ্যের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তোলে।যখন খাবার টেবিলে শোর্ষে রুই আসে, তখন তা কেবল পেট ভরায় না—এটি স্মৃতি জাগায়, সংস্কৃতির কথা বলে এবং মনে করিয়ে দেয় যে প্রকৃত সুস্থতা অনেক সময় লুকিয়ে থাকে আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের মধ্যেই।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।