স্নায়ু ধ্বংসকারী পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথির লক্ষণ, কারণ এবং চিকিৎসা!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
-
আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা, চাপ এবং অনিয়মিত জীবনধারা আমাদের দেহ ও মনকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি শারীরিক, মানসিক বিভিন্ন ভাবে। বর্তমান সময়ে তেমনি এক নীরব শত্রু হলো পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি । এটি একটি স্নায়ুজনিত রোগ যা প্রাথমিকভাবে খুব সহজ লক্ষণে প্রকাশ পায়, ফলে অনেকেই উপেক্ষা করেন। কিন্তু সময়মতো শনাক্ত না করলে এটি স্থায়ী ক্ষতি এবং জীবনযাত্রার মান হ্রাস করতে পারে।
পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি হলো পেরিফেরাল নার্ভসের ব্যাধি। পেরিফেরাল নার্ভস হলো সেই স্নায়ুসমূহ যা মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের বাইরে দেহের বিভিন্ন অংশে সংকেত পৌঁছে দেয়। সঠিকভাবে কাজ না করলে এই স্নায়ু শরীরের পেশী, স্পর্শ, তাপমাত্রা ও ব্যথার অনুভূতি দিতে ব্যর্থ হয়। ফলে, রোগী ধীরে ধীরে নিজের দেহের সঙ্গে সংযোগ হারাতে শুরু করে।একে বেশ কিছু প্রকারে ভাগ করা যায়। যেমন:
◑ সেন্সরি নিউরোপ্যাথি: হাত, পা বা শরীরের অন্য অংশে কম্পন, ঝিনঝিন অনুভূতি বা দগ্ধজ্বালা।
◑ মোটর নিউরোপ্যাথি: পেশীর দুর্বলতা, চলাফেরার অসুবিধা এবং সমন্বয়ের সমস্যা।
◑ অটোনমিক নিউরোপ্যাথি: স্বয়ংক্রিয় ফাংশনে সমস্যা যেমন হার্ট রেট, রক্তচাপ, হজম বা ঘাম উৎপাদন।
কারণ ও ঝুঁকি:
পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথির কারণ বহুবিধ। সবচেয়ে সাধারণগুলো:
☞ ডায়াবেটিস: অনিয়ন্ত্রিত টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এটি সবচেয়ে সাধারণ কারণ। দীর্ঘায়িত উচ্চ রক্তে শর্করার মাত্রা পেরিফেরাল স্নায়ুকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ফলে প্রায়শই পা এবং নীচের পায়ে সংবেদন হারাতে পারে।
☞ ভিটামিনের অভাব: বিশেষ করে ভিটামিন B12 ও B1-এর অভাব স্নায়ু ক্ষয় করে। অত্যধিক ভিটামিন বি 1 গ্রহণেরও এই প্রভাব থাকতে পারে।
☞ চোট বা আঘাত: হাড় ভাঙা, পেশী চোট বা সরাসরি স্নায়ুতে আঘাত।
☞ ওষুধের প্রভাব: কিছু ক্যান্সার ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক বা কেমোথেরাপি স্নায়ুর কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়।এছাড়া কিছু রাসায়নিকের সংস্পর্শেও পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি হতে পারে।
☞জেনেটিক অবস্থা: উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অবস্থা। যেমন, অ্যামাইলয়েডোসিস, ফ্যাব্রি ডিজিজ এবং চারকোট-মারি-টুথ ডিজিজ নিউরোপ্যাথি হতে পারে।
☞ সংক্রমণ: এইচআইভির মতো ভাইরাল সংক্রমণ, লাইম রোগের মতো ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ এবং শিংলসের মতো অবস্থা স্নায়ুর ক্ষতি করতে পারে।
☞ ট্রমা এবং সার্জারি: স্নায়ু আঘাত শারীরিক আঘাত বা চিকিৎসা পদ্ধতির ফলে হতে পারে।
লক্ষণ ও সতর্ক সংকেত:
পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি ধীরে ধীরে বা হঠাৎ প্রকাশ পেতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় লক্ষণগুলো অল্প হলেও ধীরে ধীরে তা বড় সমস্যায় পরিণত হয়।
সাধারণ লক্ষণ:
⇨ হাত বা পায়ের আঙুলে কম্পন, ঝিনঝিন অনুভূতি।
⇨ পেশিতে দুর্বলতা, হাঁটাচলায় অসুবিধা।
⇨ দগ্ধ বা জ্বালার অনুভূতি।
⇨ সমন্বয় ও ভারসাম্য হারানো।
⇨ অটোনমিক নিউরোপ্যাথিতে ঘাম, হার্ট রেট বা হজমে সমস্যা।
প্রাথমিক অবস্থায় রোগী প্রায়শই এটিকে সাধারণ ক্লান্তি বা বয়সজনিত সমস্যা মনে করে। তাই সচেতন থাকা গুরুত্বপূর্ণ।
প্রভাব:
এই রোগ কেবল শারীরিক ক্ষতির দিকে সীমাবদ্ধ নয়। এটি মানসিক ও সামাজিক জীবনেও প্রভাব ফেলে।
⇨ দৈনন্দিন কাজকর্মে নানা রকম অসুবিধা হয়। যেমন: হাঁটা, জুতো পরা বা লিখতে সমস্যা।
⇨ মানসিক চাপ ও হতাশা ভর করে। ক্রমাগত ব্যথা ও অস্বস্তি মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে।
⇨ আত্মনির্ভরতার ক্ষয় লক্ষনীয় হয়। সহজ কাজও অন্যের সাহায্য ছাড়া করা সম্ভব হয় না।
⇨ অল্প ব্যথা ও ঝিনঝিন ভাব অগোছালো জীবনধারায় মানসিক চাপ বাড়ায়।
চিকিৎসা:
পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি মূলত কারণ নির্ধারণ ও লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। সাধারণত, নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলি ব্যবহৃত হয়:
⇨ মেডিকেশন: পেরিফেরাল স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যার চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন ওষুধ পাওয়া যায়,তা ত্বকের প্যাচ, ধীর-রিলিজ ফর্মুলেশন ইনজেকশন, ওরাল পিল,এবং অন্যান্য ফর্মগুলির মাধ্যমে হতে পারে।
⇨ সার্জারি: অস্ত্রোপচারে বিচ্ছিন্ন স্নায়ু পুনরায় সংযোগ করার জন্য বা আটকে পড়া স্নায়ুসৃষ্ট ব্যথা উপশমের জন্য উপকারী হতে পারে। অনেক সময় অস্ত্রোপচারে ক্ষতিগ্রস্ত বা অকার্যকর স্নায়ুগুলিকে সংকেত ব্যাহত করার জন্য কাটা বা অপসারণ জড়িত থাকতে পারে।
⇨ শারীরিক চিকিৎসা: শারীরিক থেরাপি আঘাত থেকে পুনরুদ্ধার, চিকিৎসা পদ্ধতি, বা ব্যথা উপসর্গ পরিচালনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি ব্যক্তিদের স্নায়ুতন্ত্রের পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে, ভারসাম্য বাড়াতে এবং পতনের ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়তা করে।
⇨ অন্যান্য ব্যথার চিকিৎসা: ওষুধগুলি যদি ব্যথা উপশম করতে ব্যর্থ হয়, তবে ব্যথা বিশেষজ্ঞরা ট্রান্সকিউটেনিয়াস বৈদ্যুতিক স্নায়ু উদ্দীপনা, ইনজেকশন, বা মেরুদন্ডী উদ্দীপকের অস্ত্রোপচারের ইমপ্লান্টেশনের মতো বিকল্প চিকিৎসা করতে পারেন।
প্রাকৃতিক ও সহায়ককিছু পদ্ধতি:
গবেষণায় দেখা গেছে কিছু প্রাকৃতিক পদ্ধতিও কার্যকর-
⇨ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড: মাছ ও সাপ্লিমেন্ট স্নায়ু কোষ পুনর্গঠনে সাহায্য করে।
⇨ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার: বেরি, শাকসবজি, ফল স্নায়ুর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।
⇨ হালকা ব্যায়াম ও যোগব্যায়াম: রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে এবং পেশীর শক্তি ধরে রাখে।
জীবনধারার গুরুত্ব:
পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথির ক্ষেত্রে জীবনধারার পরিবর্তন অপরিহার্য।যেমন- পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাদ্য ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার মানসিক চাপ কমানো, দীর্ঘসময় বসে কাজ করার পরিবর্তে ছোট বিরতি।
সতর্কতা:
× প্রাথমিক চিহ্ন লক্ষণীয় হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
× অজানা ওষুধ বা সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা।
× জীবনধারার পরিবর্তনকে রুটিনে পরিণত করা।
পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি শুরুতে উপেক্ষণীয় মনে হলেও ধীরে ধীরে জীবনকে জটিল করে তোলে। সময়মতো সচেতনতা, স্বাস্থ্যকর জীবনধারা এবং চিকিৎসা গ্রহণ করলে রোগ ধীরগতিতে বৃদ্ধি পায় এবং অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।