ক্রিপিং ফিগ: দেয়ালে লেগে থাকা এই গাছটা কি নীরবে বাতাস শুষে নিচ্ছে?
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
-
ইট, কংক্রিট আর ধুলোর শহরে একটি দেয়াল যখন ধীরে ধীরে সবুজে ঢেকে যায়, তখন সেটি শুধু সৌন্দর্যের প্রকাশ নয়, এটি প্রকৃতির এক নীরব প্রত্যাবর্তন। ক্রিপিং ফিগ (Ficus pumila) এমনই এক লতানো উদ্ভিদ, যা অল্প যত্নে নগর জীবনের কঠিন স্থাপত্যকে নরম করে তোলে। দেয়াল, বাগান, বারান্দা কিংবা ভবনের মুখে ছড়িয়ে পড়া এই গাছটি এখন শুধু নান্দনিক উপাদান নয়। এটি পরিবেশ, বাতাসের মান এবং মানুষের মানসিক প্রশান্তির সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। বিশ্বজুড়ে নগরায়নের চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবুজের প্রয়োজনও বেড়েছে। ক্রিপিং ফিগ সেই প্রয়োজন পূরণ করছে নীরবে এবং কার্যকরভাবে।
ক্রিপিং ফিগ একটি দ্রুত বেড়ে ওঠা লতানো উদ্ভিদ, যা দেয়াল, খুঁটি কিংবা জালের গায়ে নিজেকে আঁকড়ে ধরে উপরে উঠতে পারে। এটি এক ধরনের লতানো শোভাময় উদ্ভিদ। এর ছোট, হৃদয়াকৃতির পাতাগুলো ঘনভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি প্রাকৃতিক সবুজ পর্দা তৈরি করে। ক্রিপিং ফিগ, বাংলায় লতা বট এর বৈজ্ঞানিক নাম- Ficus pumila। একে ইংরেজিতে creeping fig বা climbing fig ও বলে। এটি Moraceae পরিবারের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। মূলত এই গাছ পূর্ব এশিয়ার অধিবাসী। চীন, জাপান, ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-সেন্ট্রাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অংশ জুড়ে এই লতা বট প্রাকৃতিকৃত। এটির নামের ল্যাটিন শব্দ pumilus উল্লেখ করে এটির অর্থ বামন এবং এটির খুব ছোট পাতা তা সূত্র হিসেবে বোঝায়। বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-৪ অনুযায়ী এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। শীতপ্রধান দেশে এটি চাষ করা হয়। এই লতা বট দ্রুত বর্ধনশীল ও সামান্য যত্ন করলেই এটি বিস্তার লাভ করে। সাধারণত এই লতা বট বাড়ির দেয়ালে সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য ও শীত থেকে রক্ষা পাবার জন্য লাগানো হয়ে থাকে । এই গাছের রয়েছে কিছু বিশেষত্ব। সেগুলো হলো-
◑ অল্প মাটিতে বেড়ে ওঠার ক্ষমতা।
◑ ছায়া ও আংশিক রোদ-দু’পরিবেশেই টিকে থাকার দক্ষতা।
◑ দেয়াল বা উঁচু পৃষ্ঠে নিজে থেকেই ছড়িয়ে পড়ার স্বভাব।
এই বৈশিষ্ট্যগুলোই ক্রিপিং ফিগকে আধুনিক ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান করে তুলেছে।
বাগানে ক্রিপিং ফিগ বা লতা বট ব্যবহার করা হয় বিভিন্নভাবে। এটি মাটিতে ছড়িয়ে গ্রাউন্ড কভার হিসেবেও কাজ করতে পারে, আবার খুঁটি বা ট্রেলিসে উঠিয়ে উল্লম্ব সবুজ কাঠামো তৈরি করা যায়। এর ফলে-
◑ আগাছা কম জন্মায়।
◑ মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে।
◑ বাগানে স্তরভিত্তিক সবুজ বিন্যাস তৈরি হয়।
◑ ছোট বাগান কিংবা ছাদবাগানে এই গাছটি বিশেষভাবে কার্যকর। কারণ এটি কম জায়গায় বেশি সবুজ দেয়।
ক্রিপিং ফিগ বা লতা বট শুধু চোখের আরাম নয়, বাতাসের জন্যও উপকারী। ঘন পাতার কারণে এটি বাতাসে ভাসমান ধুলা, ক্ষুদ্র কণিকা এবং কিছু দূষণ উপাদান শোষণ করতে সক্ষম। পাতার উপরিভাগে ধুলা আটকে যায়, যা পরবর্তীতে বৃষ্টি বা পানি দেওয়ার সময় ধুয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ায় আশপাশের বাতাস তুলনামূলক পরিষ্কার থাকে। বিশেষ করে ব্যস্ত সড়কের পাশের দেয়ালে, শহরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়, বারান্দা ও জানালার কাছে এই উদ্ভিদ লাগানো হলে, স্থানীয় পর্যায়ে বাতাসের মানে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যায়।
ঘন সবুজ পাতার স্তর শব্দ শোষণেও সহায়তা করে। যদিও এটি সম্পূর্ণ শব্দরোধী সমাধান নয়, তবু যানবাহনের হালকা শব্দ বা প্রতিধ্বনি কমাতে ভূমিকা রাখে।এছাড়া ক্রিপিং ফিগ দেয়ালের ওপর সরাসরি সূর্যের আলো পড়া কমিয়ে দেয়। ফলে-
◑ দেয়াল অতিরিক্ত গরম হয় না।
◑ ঘরের ভেতরের তাপমাত্রা কিছুটা স্থিতিশীল থাকে।
◑ বিদ্যুৎচালিত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ওপর চাপ কমে।
এই দিক থেকে এটি এক ধরনের প্রাকৃতিক তাপ-ঢাল হিসেবে কাজ করে।
সবুজ পরিবেশ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ক্রিপিং ফিগের মতো গাছ চোখে পড়লে মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবেই আরাম অনুভব করে। দেয়ালে ছড়িয়ে থাকা সবুজ পাতার দিকে তাকালে চোখের ক্লান্তি কমে, মানসিক চাপ হ্রাস পায়, বাসা বা কর্মস্থলে একটি শান্ত পরিবেশ তৈরি হয়। এ কারণেই অনেক অফিস ভবন ও আবাসিক প্রকল্পে ক্রিপিং ফিগ-এর ব্যবহার বাড়ছে।
রক্ষণাবেক্ষণ:
ক্রিপিং ফিগের রক্ষণাবেক্ষণ যতটা সহজ,ঠিক ততটাই সচেতনতা জরুরী। নিয়মিত ছাঁটাই না করলে এটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং দেয়ালের ফাঁকফোকরে ঢুকে পড়ার ঝুঁকি থাকে। যত্নের মূল দিকগুলো-
◑ মাঝারি পরিমাণ পানি।
◑ অতিরিক্ত ছড়ালে ছাঁটাই।
◑ দেয়ালের গঠন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ।
সঠিক ব্যবস্থাপনায় এই গাছ দীর্ঘদিন সৌন্দর্য ও উপকারিতা ধরে রাখতে পারে।
ক্রিপিং ফিগ কোনো বিলাসী উদ্ভিদ নয়। এটি চুপচাপ দেয়ালে ওঠে, ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে, আর দেয়ালকে করে সুন্দর, বাতাসকে রাখে একটু পরিষ্কার , আর মানুষের চোখ ও মনকে দেয় অনেকটা স্বস্তি ।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।