বহুভাষিক শিক্ষা কি শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতাকে আরও শাণিত করে? বিজ্ঞান কী বলছে
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
-
একটি শিশু একই সঙ্গে দুই বা তার বেশি ভাষায় কথা বলতে পারছে এই দৃশ্য আজ আর বিস্ময় নয়। বিশ্বায়ন, অভিবাসন, বহুভাষিক সমাজ এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তারের ফলে Bilingual Education বা দ্বিভাষিক শিক্ষা এখন কেবল ভাষা শেখার পদ্ধতি নয়। এটি মস্তিষ্কের বিকাশ, চিন্তার গভীরতা এবং ভবিষ্যৎ সক্ষমতা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বহুভাষিকতার একটি উপসেট বা অংশ হলো দ্বিভাষিকতা। দ্বিভাষিকতা বলতে দুটি ভাষায় দক্ষতা থাকাকে বোঝায়। সাধারণভাবে, একজন দ্বিভাষিক ব্যক্তি হলেন তিনি, যিনি নিয়মিতভাবে দুটি ভাষা বুঝতে পারেন এবং ব্যবহার করতে পারেন। দ্বিভাষিকতার অনেক সময় শৈশবকালেই শুরু হয়, যেমন ৩ বছর বয়সের আগেই। তবে এটি জীবনের পরের সময়েও শুরু হতে পারে, একভাষিক বা দ্বিভাষিক শিক্ষার মাধ্যমে। সাধারণত একজন দ্বিভাষিক ব্যক্তির দুটি ভাষায় সমান দক্ষতা থাকে না। দক্ষতার মাত্রা পরিস্থিতি ও ব্যবহারের ক্ষেত্র অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়।
মানুষের মস্তিষ্কে ভাষা প্রক্রিয়াকরণের জন্য নির্দিষ্ট অঞ্চল রয়েছে। একটি ভাষা শেখার সময় মস্তিষ্ক শব্দ, ব্যাকরণ, অর্থ এবং ধ্বনির মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করে। কিন্তু যখন একজন মানুষ দুই বা তার বেশি ভাষা নিয়মিত ব্যবহার করে, তখন মস্তিষ্ককে একসঙ্গে একাধিক ভাষাগত ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় করতে হয়। এই সমন্বয় প্রক্রিয়ায় আমাদের ব্রেনের মনোযোগ নিয়ন্ত্রণকারী অংশ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্র, স্মৃতি ও তথ্য বাছাইয়ের ক্ষমতা সক্রিয় হয়। ফলে মস্তিষ্ক কেবল ভাষা শেখে না, বরং নিজেকে আরও দক্ষভাবে পরিচালনা করতে শেখে।
একজন দ্বিভাষিক ব্যক্তির মস্তিষ্ক সব সময় দুই ভাষাকেই সক্রিয় অবস্থায় রাখে। কথা বলার সময় তাকে মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কোন ভাষাটি ব্যবহার করা হবে, কোন শব্দটি উপযুক্ত, কোন ব্যাকরণ প্রযোজ্য। এই বাছাইয়ের কাজটি হয় অবচেতনভাবে, কিন্তু এর জন্য মস্তিষ্কের অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ দরকার। এই কারণে দ্বিভাষিক ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায় মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা তুলনামূলক বেশি। এছাড়া অপ্রাসঙ্গিক তথ্য এড়িয়ে যাওয়ার দক্ষতা, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভ্যাসও দেখা যায়। এগুলো সরাসরি ভাষার বাইরের কাজেও প্রভাব ফেলে, যেমন গণিত, সমস্যা সমাধান বা বিশ্লেষণধর্মী চিন্তায়।
শিশুদের মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবেই নমনীয় হয় । এই বয়সে একাধিক ভাষার সংস্পর্শে এলে মস্তিষ্ক নতুন ভাষাগত কাঠামো গ্রহণকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে না নিয়ে, স্বাভাবিক শেখার প্রক্রিয়া হিসেবে নেয়। শুরুতে কিছু শিশু হয়তো একটি ভাষায় শব্দ বলতে দেরি করতে পারে, বা দুই ভাষার শব্দ মিশিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু এটি বিভ্রান্তির লক্ষণ নয়। এটি ইঙ্গিত দেয় যে শিশুর মস্তিষ্ক একই সঙ্গে দুটি ভাষার নিয়ম আয়ত্ত করছে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এই শিশুরা ভাষাগত পার্থক্য দ্রুত বুঝতে শেখে এবং নতুন শব্দ ও ধারণা গ্রহণে বেশি সক্ষম হয়।তারা পড়াশোনায় বিমূর্ত ধারণা বুঝতে সুবিধা পায়। শিক্ষাবিদদের মতে, প্রাথমিক বয়সে দ্বিভাষিক শিক্ষা শিশুর শেখার ভিত্তিকে আরও শক্ত করে।
স্মৃতি ও মনোযোগে ইতিবাচক প্রভাব:
একাধিক ভাষা ব্যবহারের কারনে মস্তিষ্কের কর্মস্মৃতি নিয়মিত অনুশীলনের সুযোগ পায়। একটি বাক্য বলার সময় কোন শব্দটি ব্যবহার হবে, বাক্যের গঠন কী হবে এসব সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে হয়। এই অভ্যাসের কারণে দ্বিভাষিকদের মধ্যে দেখা যায়-
◑ দীর্ঘ সময় মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা।
◑ একসঙ্গে একাধিক কাজ সামলানোর দক্ষতা।
◑ তথ্য মনে রাখার প্রবণতা।
এগুলো শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি পেশাগত জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, যারা জীবনের বড় একটি সময় একাধিক ভাষা ব্যবহার করেন, তাদের ক্ষেত্রে বয়সজনিত স্মৃতিভ্রংশের লক্ষণ তুলনামূলক দেরিতে দেখা দিতে পারে। এর কারণ হিসেবে ধরা হয় cognitive reserve-অর্থাৎ মস্তিষ্কের অতিরিক্ত সক্ষমতা, যা নিয়মিত মানসিক অনুশীলনের ফলে তৈরি হয়। একাধিক ভাষা ব্যবহার করা মানে মস্তিষ্ককে নিয়মিত চ্যালেঞ্জ দেওয়া। এই চ্যালেঞ্জ মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে এবং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষতা কমে যাওয়ার গতি ধীর করতে পারে।
ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি চিন্তার কাঠামোও নির্ধারণ করে। ভিন্ন ভাষায় একই ধারণা প্রকাশের ভিন্ন ভিন্ন উপায় থাকে। ফলে দ্বিভাষিক ব্যক্তিরা একটি সমস্যাকে একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে অভ্যস্ত হন। এই কারণে দ্বিভাষিকদের মধ্যে সৃজনশীল সমাধান খোঁজার প্রবণতা, বিকল্প চিন্তা করার দক্ষতা, নতুন ধারণা গ্রহণের মানসিক প্রস্তুতি তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়।
যদিও দ্বিভাষিক শিক্ষার সুফল অনেক, বাস্তব প্রয়োগে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সঠিক পদ্ধতি ছাড়া ভাষা শেখানো হলে শিক্ষার্থী হয়তো কোনো ভাষাতেই পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। কার্যকর দ্বিভাষিক শিক্ষার জন্য পরিকল্পিত পাঠ্যক্রম, শিক্ষকদের ভাষাগত ও পেডাগোজিক দক্ষতা এবং শিক্ষার্থীর মাতৃভাষার প্রতি সম্মান প্রয়োজন। ভাষাকে চাপ হিসেবে নয়, দক্ষতা হিসেবে উপস্থাপন করাই এখানে মূল বিষয়।
দ্বিভাষিক শিক্ষা কেবল মস্তিষ্কের উন্নয়নের পাশাপাশি, সামাজিক সংযোগও বাড়ায়। একাধিক ভাষা জানা মানুষ ভিন্ন সংস্কৃতি বুঝতে পারে, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান করতে শেখে। এতে গড়ে ওঠে
সহনশীল মানসিকতা, বৈচিত্র্য গ্রহণের অভ্যাস এবং বিশ্বনাগরিক হিসেবে নিজেকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। এই সামাজিক দক্ষতাগুলো আধুনিক বিশ্বে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
অসুবিধা:
সিঙ্গাপুর ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটি ( SMU ) স্কুল অফ সোশ্যাল সায়েন্সেস অনুসারে , ১৯৬০-এর দশকের আগে দ্বিভাষিক ব্যক্তিদের উপর গবেষণা বিভিন্ন রকমের ছিল। কিন্তু সাধারণত এই ধারণাটিকে সমর্থন করত যে দ্বিভাষিকতার নানা রকম অসুবিধাও রয়েছে। গবেষকরা বিশ্বাস করতেন যে, দ্বিভাষিকদের শব্দভাণ্ডার কম হবে এবং জ্ঞানীয় ক্ষমতাও হ্রাস পাবে। তারা আরও মনে করতেন যে অল্প বয়সে দুটি ভাষা শেখা শিশুদের দুটি ভাষাতে দক্ষতা অর্জনের জন্য দুটি ভাষা পার্থক্য করতে এবং দক্ষতা অর্জন করতে সমস্যা হবে। দ্বিভাষিক হওয়া শিশুর ভাষাগত এবং জ্ঞানীয় বিকাশের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। "দ্য জার্নাল অফ জেনেটিক সাইকোলজি"-এর একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা অনুসারে, বিভিন্ন গবেষক এই বিশ্বাসগুলি ধারণ করেছিলেন, "দ্বিভাষিকতার সমস্যা" বা "দ্বিভাষিকতার প্রতিবন্ধক প্রভাব" উল্লেখ করে।
দ্বিভাষিক শিক্ষা মানুষের মনোযোগ, স্মৃতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সৃজনশীল চিন্তার ওপর দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও শিক্ষাবিষয়ক গবেষণাগুলো বলছে, ভাষা এখানে শুধু শব্দের বিনিময় নয়, এটি মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যপ্রণালীর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। একটি মস্তিষ্ক যখন একাধিক ভাষায় চিন্তা করতে শেখে, তখন সে কেবল বেশি কথা বলতে পারে না,সে বেশি ভাবতে পারে, গভীরভাবে বুঝতে পারে, আর ভবিষ্যতের জটিল বিশ্বকে সামলাতে নিজেকে আরও প্রস্তুত করে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।