নক্ষত্রের বিস্ফোরণে ফুটে উঠল মহাবিশ্বের মৃত্যুর গল্প!

নক্ষত্রের বিস্ফোরণে ফুটে উঠল মহাবিশ্বের মৃত্যুর গল্প!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

রাতের আকাশে একটি নক্ষত্র নিভে গেলে আমরা সাধারণত তাকে হারিয়ে যাওয়া আলো হিসেবেই দেখি। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায়, কিছু নক্ষত্র নিভে যাওয়ার আগে এক বিশাল বিস্ফোরণে ফেটে পড়ে। এই বিস্ফোরণই সুপারনোভা। সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণগুলো দেখাচ্ছে, সুপারনোভা কেবল নক্ষত্রের মৃত্যু নয়। এটি মহাবিশ্বের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বোঝার এক গভীর দলিল। সুপারনোভা বলতে একটি নক্ষত্রের জীবনের শেষ অধ্যায় বোঝায়। কিন্তু এই শেষ অধ্যায় এতটাই শক্তিশালী যে, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটি নক্ষত্র তার পুরো জীবনে যত শক্তি তৈরি করেছে, তার চেয়েও বেশি শক্তি ছড়িয়ে দিতে পারে।

নক্ষত্রের জন্ম হয় গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘ থেকে। কোটি কোটি বছর ধরে চলা এই প্রক্রিয়ার শেষে নক্ষত্র তার জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলে। ছোট নক্ষত্রগুলো ধীরে ধীরে নিভে যায়, কিন্তু বৃহৎ নক্ষত্রের ভাগ্যে থাকে আরও নাটকীয় এক পরিণতি। যখন ভেতরের পারমাণবিক জ্বালানি শেষ হয়ে আসে, তখন মাধ্যাকর্ষণ আর চাপের ভারসাম্য ভেঙে পড়ে। ফলাফল দাঁড়ায় একটি ভয়াবহ বিস্ফোরণ! যাকে আমরা সুপারনোভা বলি। সাম্প্রতিক সুপারনোভা পর্যবেক্ষণগুলোতে বিজ্ঞানীরা আগে দেখা না যাওয়া কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছেন। বিস্ফোরণের আলো কত দ্রুত বাড়ছে ও কমছে, কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে সবচেয়ে বেশি শক্তি নির্গত হচ্ছে, এবং আশপাশের মহাকাশে কী ধরনের মৌল ছড়িয়ে পড়ছে!এসব তথ্য আগের ধারণাগুলোকেও চ্যালেঞ্জ করছে। দেখা যাচ্ছে, সব সুপারনোভা একই নিয়মে ঘটে না। তাদের মৃত্যুর ধরন ভিন্ন ভিন্ন গল্প বলে। বিশেষ করে টাইপ-আইএ সুপারনোভা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। এই ধরনের সুপারনোভা বহু বছর ধরে মহাবিশ্বের দূরত্ব মাপার মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। কারণ এগুলোর বিস্ফোরণ তুলনামূলকভাবে একরকম উজ্জ্বল হয়। কিন্তু নতুন পর্যবেক্ষণ বলছে, এই উজ্জ্বলতার মধ্যেও সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্যগুলো মহাবিশ্বের প্রসারণের হিসাবকে আরও নিখুঁত করার সুযোগ দিচ্ছে, একই সঙ্গে নতুন অনিশ্চয়তাও তৈরি করছে।

মহাবিশ্বের মৃত্যু নিয়ে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে নানা তত্ত্ব আলোচনা করছেন। কেউ বলছেন, মহাবিশ্ব ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে যাবে। সব নক্ষত্র নিভে যাবে এবং শক্তি ছড়িয়ে পড়ে নিস্তেজ হয়ে পড়বে। কেউ আবার মনে করেন, একসময় মহাবিশ্ব নিজেই নিজের ভেতরে ধসে পড়তে পারে। সুপারনোভা পর্যবেক্ষণ এই বিতর্কে নতুন তথ্য যোগ করছে। কারণ এই বিস্ফোরণগুলো দেখাচ্ছে, মহাবিশ্ব কীভাবে শক্তি ও পদার্থকে প্রতিনিয়ত পুনর্বণ্টন করছে। নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, সুপারনোভা বিস্ফোরণের সময় যে মৌলগুলো তৈরি হয়, সেগুলোই ভবিষ্যতের নক্ষত্র, গ্রহ এবং এমনকি জীবনের উপাদান হয়ে ওঠে। লোহা, স্বর্ণ, ইউরেনিয়ামের মতো ভারী মৌল সাধারণ নক্ষত্রে তৈরি হয় না। এগুলোর জন্ম হয় সুপারনোভার ভয়াবহ চাপে ও তাপে। অর্থাৎ, এক নক্ষত্রের মৃত্যু থেকেই জন্ম নেয় নতুন সম্ভাবনা। এই চক্রই মহাবিশ্বকে গতিশীল রাখে। তবে সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে একটি অস্বস্তিকর দিকও উঠে এসেছে। কিছু সুপারনোভা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি শক্তিশালী এবং কিছু আবার অস্বাভাবিকভাবে দুর্বল। এই বৈচিত্র্য বিজ্ঞানীদের ভাবাচ্ছে, নক্ষত্রের ভেতরের প্রক্রিয়া কি আমরা পুরোপুরি বুঝতে পেরেছি নাকি এর পেছনে কাজ করছে  আরও অজানা পদার্থবিদ্যা? এই প্রশ্নগুলো মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি সম্পর্কিত ধারণাকেও প্রভাবিত করতে পারে। ডার্ক এনার্জি বা অজানা শক্তির প্রসঙ্গ এখানে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মহাবিশ্ব যে দ্রুতগতিতে প্রসারিত হচ্ছে, তা বোঝার অন্যতম প্রমাণ এসেছে সুপারনোভা পর্যবেক্ষণ থেকেই। নতুন তথ্যগুলো দেখাচ্ছে, এই প্রসারণ হয়তো সময়ের সঙ্গে বদলাচ্ছে। যদি ডার্ক এনার্জির আচরণ বদলায়, তাহলে মহাবিশ্বের শেষ পরিণতিও অন্যরকম  হতে পারে। অর্থাৎ, সুপারনোভা শুধু নক্ষত্রের মৃত্যু নয়, পুরো মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ নির্দেশকও। প্রযুক্তির অগ্রগতিও এই নতুন পর্যবেক্ষণে বড় ভূমিকা রাখছে। আগের মতো শুধু দৃশ্যমান আলো নয়, এখন বিজ্ঞানীরা রেডিও, এক্স-রে ও গামা রশ্মির মাধ্যমেও সুপারনোভা পর্যবেক্ষণ করছেন। ফলে বিস্ফোরণের প্রতিটি ধাপ আরও বিস্তারিতভাবে ধরা পড়ছে। এই বহুমাত্রিক পর্যবেক্ষণ নক্ষত্রের মৃত্যুকে একক ঘটনা নয়, বরং একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া হিসেবে বুঝতে সাহায্য করছে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সময়। কিছু সুপারনোভা এমন দূরত্বে ঘটেছে, যে তার আলো আমাদের কাছে পৌঁছাতে কোটি কোটি বছর লেগেছে। অর্থাৎ, আমরা যখন সেগুলো দেখি, তখন আসলে মহাবিশ্বের প্রাচীন ইতিহাসের দিকে তাকাই। নতুন পর্যবেক্ষণগুলো সেই প্রাচীন মহাবিশ্বের আচরণ সম্পর্কে ইঙ্গিত দিচ্ছে।  তখন নক্ষত্রের জন্ম ও মৃত্যু কি আজকের মতোই ছিল, নাকি ভিন্ন?এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের “মৃত্যু” শব্দটিকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করছেন। মৃত্যু এখানে সম্পূর্ণ শেষ যাওয়া নয়, এক রূপান্তর মাত্র ।সুপারনোভা দেখায়, ধ্বংসের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি এগোয়। কিন্তু একই সঙ্গে এটি মনে করিয়ে দেয়, শক্তির উৎস একদিন নিঃশেষ হবেই। নক্ষত্রের মৃত্যু তাই মহাবিশ্বের অনিবার্য পরিণতিরই প্রতীক। মানুষের অস্তিত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে এই পর্যবেক্ষণগুলো আরও গভীর অর্থ বহন করে। আমাদের শরীরের প্রতিটি ভারী মৌল কোনো না কোনো সুপারনোভার উত্তরাধিকার। এই উপলব্ধি বিজ্ঞানকে কেবল গণিত বা সমীকরণের বিষয় না রেখে মানবিক করে তোলে।

ইতিমধ্যেই গবেষকরা প্রাথমিক মহাবিশ্বে বস্তু দ্বারা নির্গত গামা-রশ্মি বিস্ফোরণ সম্পর্কে আরও জানার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় রয়েছে। তারা ওয়েবকে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করেছেন। গবেষক দলটিকে ওয়েবের সাথে ঘটনাগুলি পর্যবেক্ষণ করার জন্য অনুমোদিত করা হয়েছে। এখন তাদের একটি নতুন লক্ষ্য রয়েছে- গামা-রশ্মি বিস্ফোরণের পরবর্তী আভা নিজেই ধারণ করে দূরবর্তী মহাবিশ্বের ছায়াপথগুলি সম্পর্কে আরও জ্ঞান নেওয়া।

সুপারনোভা পর্যবেক্ষণ মুলত আমাদের সামনে মহাবিশ্বের এক জটিল কিন্তু সুশৃঙ্খল ছবি তুলে ধরছে। নক্ষত্রের মৃত্যু এখানে শেষ নয়। এটি একটি বার্তা- মহাবিশ্ব পরিবর্তনশীল, গতিশীল এবং একদিন তারও পরিণতি আছে। সুপারনোভা সেই পরিণতির আগাম ইঙ্গিত বহন করে, যেখানে আলো নিভে যাওয়ার মধ্য দিয়েই লেখা হয়  ভবিষ্যতের গল্প।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ