নারীবিদ্বেষী কারা? কথার আড়াল ও আচরণের ছায়ায় নীরব সহিংসতার অনুসন্ধান!

নারীবিদ্বেষী কারা? কথার আড়াল ও আচরণের ছায়ায় নীরব সহিংসতার অনুসন্ধান!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

নারীবিদ্বেষ বা ‘Misogyny একটি জটিল সামাজিক ও মানসিক প্রক্রিয়া। শব্দের ফাঁক, আচরণের ছায়া এবং নীরব সহিংসতার মাধ্যমে সমাজে লুকিয়ে থাকে এই নারীবিদ্বেষ। তবে এটি হঠাৎ করেই প্রকাশ পায় না। কোনো এক উল্লিখিত বাক্য, আচরণ বা কটাক্ষ কখনোই প্রথম দেখাতেই সহজে বোঝা যায় না। বরং এটি ধীরে ধীরে একটি সুসংহত মানসিক কাঠামো গড়ে তোলে, যার মূল লক্ষ্য নারীকে কম শক্তিশালী, কম গুরুত্বপূর্ণ এবং কম বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করা।

নারী বিদ্বেষ বলতে মহিলা বা নারীর প্রতি ঘৃণা বা তীব্র বিরাগ বোঝায়। এর থেকেই পরবর্তীতে জন্ম নেয় যৌন নিপীড়নের মত বিকৃত মানসিকতা। অর্থাৎ কোনো নারী যদি পুরুষটির নির্বাচনে সহমত পোষণ করে তবেই তিনি যথাযোগ্য সম্মানের অধিকারিণী অন্যথায় সেই নারীই হবে চরম অপমান ও অসম্মান ও শাস্তির যোগ্য প্রাপক। নারীবিদ্বেষ সমাজে পুরুষ আধিপত্যবাদী ধারণা, যৌন বৈষম্য,শত্রুতা,সহিংসতা, মর্যাদাহানি এবং নারীর আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে তাকে ভোগ করার বাসনা তৈরি করে। স্ত্রী-বিদ্বেষের প্রমাণ ইতিহাস ঘাঁটলেও অনেক পাওয়া যায়। 

নারীবিদ্বেষকে প্রাচীন গ্রীক ইতিহাসে একটি অসুখ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়াও প্রাচ্যের কিছু প্রাচীন ধর্মীয় গ্রন্থ এবং পাশ্চাত্যের কিছু দর্শনের গ্রন্থেও এই নারীবিদ্বেষের উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে, বিভিন্ন পুরাণ সংক্রান্ত প্রাচীন গ্রন্থের মধ্যে পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে কিছু প্রভাবশালী পশ্চিমী দার্শনিক ও চিন্তাবিদ গনের এ সম্পর্কে কথিত মতবাদও পাওয়া যায়। নারীবিদ্বেষের বিপরীত মতবাদ হচ্ছে পুরুষবিদ্বেষ। নারীর প্রতি সহিংসতা বা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা হচ্ছে সহিংস অপরাধগুলো যেগুলো প্রধাণত বা শুধুমাত্রই নারী বা বালিকাদের উপরেই করা হয়ে থাকে । জাতিসংঘের ডেকলারেশন অন দ্য ডেকলারেশন অফ ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন থেকে বলা হয়, "সহিংসতা হচ্ছে নারীর বিরুদ্ধে নারী ও পুরুষের মধ্যকার ঐতিহাসিক অসম ক্ষমতা সম্পর্কের প্রকাশ" এবং "নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা হচ্ছে প্রধান সামাজিক কৌশলগুলোর মধ্যে একটি যার দ্বারা নারীদেরকে পুরুষের তুলনায় অধীনস্থ অবস্থানে জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়া হয়।"

নারীবিদ্বেষ বেশিরভাগ সময়ই ভাষার মধ্যে  লুকিয়ে থাকে। নারীর প্রতি বিদ্বেষ সব সময় সবাইকে বলে কয়ে  আসে না। অনেক সময় তা আসে হাসির ছলে, ‘সাধারণ কথা’ ভেবে বলা মন্তব্যে, কিংবা সমাজে দীর্ঘদিন ধরে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া আচরণের আড়ালে। নারীবিদ্বেষ এমন এক মানসিকতা, যা প্রকাশ্য অপমানের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর হয়ে ওঠে তখনই যখন তা অদৃশ্য থাকে কিন্তু প্রভাব ফেলে সিদ্ধান্তে, সম্পর্কের ভারসাম্যে, কর্মক্ষেত্রে সুযোগে এবং নারীর আত্মমূল্যায়নে। আধুনিক সমাজে প্রযুক্তি, শিক্ষা ও আইনের অগ্রগতির মাঝেও নারীবিদ্বেষ পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি রূপ বদলে আরও সূক্ষ্ম ও কৌশলী হয়েছে মাত্র। নারীবিদ্বেষী মানুষের আচরণ প্রায়শই দ্বৈত রূপে প্রকাশ পায়। শুরুতে তারা ভদ্র, সহযোগিতাপূর্ণ, বন্ধুত্বপূর্ণ এবং  খুব সহায়ক বলে মনে হয়। এই অতিরিক্ত ভদ্রতা অনেক সময় একটি মুখোশ হিসেবে কাজ করে। সময়ের সাথে সাথে সেই আচরণ পরিবর্তন হতে দেখা যায়। হঠাৎ ঠান্ডা অবজ্ঞা, রূঢ়তা বা নির্দিষ্ট নারীদের প্রতি বিশেষ অনীহা প্রকাশ ফুটে ওঠে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই দ্বৈত আচরণ নারীকে বিভ্রান্ত করে ফেলে। কারণ আচরণের ওঠানামা স্পষ্ট আঘাতের মতো নয়। তবে তা ধীরে ধীরে মানসিক ক্ষয় সৃষ্টি করে। এটি প্রাথমিকভাবে সম্পর্ক ও কর্মক্ষেত্রে নারীকে সতর্ক করে, পরবর্তীতে আত্মবিশ্বাসে 

করতে পারে স্থায়ী ক্ষতি।

নারীবিদ্বেষের শিকড় সাধারণত শৈশবেই গড়ে ওঠে। একটি ছেলে ছোটবেলা থেকেই  যদি দেখেন - নারীরা কম কথা বলে, পুরুষের কাছে সিদ্ধান্ত নিতে কমনীয় হচ্ছে, এবং পরিবারে বা সমাজে নারীদের অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে, তাহলে তার মস্তিষ্কে এই ধারণা ধীরে ধীরে গেঁথে যেতে শুরু করে। স্কুল, মিডিয়া, বন্ধু–পরিবারের আচরণ সব মিলিয়ে এই ধারণাকে শক্তিশালী করে তোলে।

অধিকন্তু, ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতাও গুরুত্বপূর্ণ। কোনো নারী দ্বারা প্রত্যাখ্যান, অপমান বা অবহেলার অভিজ্ঞতা থাকলে, তা অবচেতনে ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি করে। এই ক্ষোভ অনেকসময় সরাসরি প্রকাশ পায় না, কিন্তু ধীরে ধীরে একটি সামগ্রিক নেতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলে। এতে সব নারীকেই  অবিশ্বাসযোগ্য বা সমস্যাসৃষ্টিকারী হিসেবে মনে হতে শুরু হয় ।

কর্মক্ষেত্র নারীবিদ্বেষের অন্যতম প্রধান মঞ্চই বল চলে। গবেষণায় দেখা গেছে, একই কাজ একজন পুরুষ করলে তার সফলতা প্রশংসা পায়, কিন্তু নারী করলে সেটিকে ভাগ্য বা সুযোগের ফল বলে দেখা হয়। নারীর কাজকে ছোট করে দেখানো, ভুলকে অতিরঞ্জিত করা, সাফল্যকে অবমূল্যায়ন করা এসব আচরণ আমাদের সমাজে খুবই সাধারণ। মিটিং, প্রেজেন্টেশন বা দলীয় আলোচনায় নারীর মতামত উপেক্ষা করা, তার সময়কে গুরুত্ব না দেওয়া এসবই মুলত নিঃশব্দ বৈষম্য। আচরণবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ‘নীরব বৈষম্য’ নারীকে মানসিকভাবে ক্লান্ত ও নিরাপত্তাহীন করে তোলে।

নারীবিদ্বেষ সরাসরি অপমানমূলক ভাষায় প্রকাশ পায় না ঠিকই, তবে কটাক্ষ, ব্যঙ্গ বা তথাকথিত রসিকতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, “মেয়েরা এসব বোঝে না” বা “ও তো আবেগপ্রবণ” শব্দগুলো প্রথমে হালকা মনে হয়, কিন্তু বারবার শুনলে নারীর আত্মবিশ্বাস ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকে। সামাজিক মনোবিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এ ধরনের ভাষার ব্যবহার নারীকে নিজের সক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান করে ফেলে। এতে করে, সে নিজের সিদ্ধান্ত, কাজের দক্ষতা বা সৃজনশীলতাকে ছোট করে দেখতে শুরু করে।

নারীবিদ্বেষী মানুষ প্রায়শই নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। কী পরবে, কার সঙ্গে মিশবে, কী সিদ্ধান্ত নেবে সবকিছুতে হস্তক্ষেপের চেষ্টা চালিয়ে যায় তারা। তারা নিজেদের এই আচরণকে ভালোবাসা বা দায়িত্ববোধ হিসেবে দেখিয়ে থাকে, কিন্তু বাস্তবে এটি নারীর স্বাধীনতার ওপর মানসিক দখল। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ধরণের নিয়ন্ত্রণ নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। এটি অবচেতনভাবে তার চিন্তাধারা ও আচরণকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে পাশাপাশি সম্পর্কের মধ্যে যথাযথ সমতা গড়ে ওঠাকে বাধাগ্রস্ত করে।

নারী যদি কর্মক্ষেত্রে পারদর্শিতা, নেতৃত্ব বা প্রকাশ্য সাফল্য অর্জন করে, তখন নারীবিদ্বেষী পুরুষ তা ব্যক্তিগত হুমকি হিসেবে গ্রহণ করে। এই হুমকির প্রতিক্রিয়ায় শুরু হয় অবমূল্যায়ন, তার কাজ নিজের নামে নেওয়া বা তার সাফল্যকে ছোট করে দেখানোর  কঠিন প্রচেষ্টা। একই সফলতা যদি কোনো পুরুষ অর্জন করে, তার প্রতিক্রিয়া স্বভাবতই  সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়। এই ভিন্ন আচরণ দেখায়, সমস্যাটি মোটেও ব্যক্তিগত নয় বরং লিঙ্গভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিরই ফল। নারীর প্রতি এই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া শুধু মানসিক অবসাদ তৈরি করে না, কর্মক্ষেত্রে তার অগ্রগতিকেও ব্যাহত করে।
 

ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীবিদ্বেষ আরও ক্ষতিকর রূপ নিয়ে থাকে। এমন পুরুষরা প্রায়শই সঙ্গীর ইচ্ছা ও চাহিদাকে উপেক্ষা করে। প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন, দ্রোহিতা, আকস্মিক বিচ্ছিন্নতা এসব তারা খুবই স্বতঃসিদ্ধ   মনে করে। কখনও বা আবেগঘন গল্প বানিয়ে সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করার চেষ্টা করে। এই দোলাচল নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদে এবং গভীর প্রভাব ফেলে। আস্থা হারানো, উদ্বেগ, আত্মসম্মানের ক্ষয় এবং হতাশা,  প্রায়শই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফলাফল হিসেবে লক্ষণীয় হয় ।

মনোবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান একে একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখে। এটি কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, একটি সামাজিক ব্যাধি, যা ভাষা, আচরণ, শৈশবের শিক্ষা এবং সামাজিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। গবেষণা দেখায়, সচেতনতার অভাব এবং নীরবতা নারীবিদ্বেষকে আরও শক্তিশালী করে।

২০০৬ সালে, ইউনাইটেড ন্যাশনস ডেভেলপমেন্ট ফান্ড ফর উইমেন (UNIFEM)-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে, জাতিসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব কফি আনান ঘোষণা করেছিলেন: দিন দিন নারী ও বালিকাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা একটি পৃথিবীব্যাপি বিরাজমান সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সমগ্র বিশ্বজুড়ে তিন জন নারীর অন্তত একজনকে মারা হয়েছে, জোরপূর্বক যৌনক্রিয়া করতে বাধ্য করা হয়েছে, বা অন্য কোনভাবে তার জীবনে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে।যেখানে নির্যাতনকারী কোনভাবে তার পরিচিতও ছিল।

 

নারীর সুরক্ষামূলক দিকনির্দেশনা:

১. সচেতনতা তৈরি: আচরণের সূক্ষ্ম ইঙ্গিত, কথার আড়ালে থাকা অবমূল্যায়ন ও অস্বস্তিকর ভঙ্গি লক্ষ্য করুন।

২. প্রশ্ন তোলা: সন্দেহজনক মন্তব্য, অবহেলা বা বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার মানসিকতা গড়ে তুলুন।

৩. নিজের অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেওয়া: নিজেকে তুচ্ছ মনে না করে অভিজ্ঞতাকে স্বীকৃতি দিন।

৪. সীমা নির্ধারণ: ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও কর্মক্ষেত্রে নিজের সীমারেখা স্থির করুন এবং তা স্পষ্টভাবে জানাতে শিখুন।

৫. সামাজিক সমর্থন: বন্ধু, সহকর্মী বা পরামর্শদাতার সহায়তা নিন। সমবেদনা ও সমর্থন মানসিক শক্তি জোগায়।

 

নারীবিদ্বেষ মূলত  একক কোনো বিষয় নয়। এটি একটি সামাজিক ও মানসিক প্রক্রিয়া। এটি ভাষা, আচরণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সম্পর্কের প্রতিটি স্তরে লুকিয়ে থাকে। তবে সচেতনতা, প্রশ্ন তোলা এবং স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে এই নীরব সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। আজ যা কথার আড়ালে লুকিয়ে আছে, কাল তা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। তাই প্রতিটি নারীকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে, নিজের মূল্য বোঝাতে।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ