দুপুরে মাত্র ১৫ মিনিটের ঘুমই কি কাজে মনোযোগ বাড়ায়?

দুপুরে মাত্র ১৫ মিনিটের ঘুমই  কি কাজে মনোযোগ বাড়ায়?
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

দুপুর গড়াতে গড়াতেই চোখ ভারী হয়ে আসার অভিজ্ঞতা আমাদের প্রায় সবারই। অফিসের ডেস্কে, ক্লাসরুমে, কিংবা বাসায় কাজ করতে করতে হঠাৎ মনোযোগ ছুটে যায়। কফির কাপ শেষ হয়, কিন্তু ক্লান্তি কাটে না। তারপরও অনেকেই মনে করেন, দুপুরে ঘুম মানেই কাজের ক্ষতি বা নিছক অলসতা। এদিকে আধুনিক বিজ্ঞান কিন্তু বলছে ভিন্ন সুরে। প্রশ্নটি এখন আর ঘুমানো ঠিক কি না তে আটকে রইনি বরং এখন প্রশ্ন হলো, দুপুরে মাত্র ১৫ মিনিটের ছোট ঘুম কি সত্যিই কাজের মনোযোগ বাড়াতে পারে? এই বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্নায়ুবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও কর্মদক্ষতা-গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। সেসব তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সঠিকভাবে নেওয়া ছোট ঘুম শরীর ও মস্তিষ্কের জন্য অলসতা নয়, এটি হতে পারে কার্যকারিতা বাড়ানোর একটি ফলপ্রসূ হাতিয়ার।

মানুষের শরীর একটি প্রাকৃতিক জৈব ঘড়ির অধীনে চলে,যাকে সার্কাডিয়ান রিদম বলে। এই ঘড়ি রাতে ঘুম আর দিনে জাগ্রত থাকার নির্দেশই শুধু দেয় না, দিনের মাঝামাঝি সময়েও এটি শরীরকে সাময়িক বিশ্রামের সংকেত দিয়ে থাকে। সাধারণত দুপুর ১টা থেকে ৩টার মধ্যে শরীরের সতর্কতা কিছুটা কমে আসে।যদিও ভারী খাবার ক্লান্তি বাড়াতে পারে,তবে এটি খাবার খাওয়ার কারণে নয়। এর মূল কারণ, সে সময়ে মস্তিষ্কের জাগ্রত রাখার সংকেত কিছুটা দুর্বল হয়ে যায়। ইতিহাসের দিকে তাকালেও দেখা যায়, বহু সংস্কৃতিতে দুপুরের ঘুম বা স্বল্প বিশ্রাম একটি স্বাভাবিক রীতি ছিল। আধুনিক কর্মব্যস্ত জীবন সেই স্বাভাবিক প্রবণতাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, কিন্তু শরীর এখনো তার নিজস্ব নিয়মেই চলছে।

দুপুরের ঘুমানোর প্রথার প্রচলন ঘটে, ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলরেখা বরাবর রোমান আমলে।যেহেতু সেই অঞ্চলে কর্মরত রোমান অভিজাতরা দুপুরের সময় তাপ সহ্য করতে অসুবিধা বোধ করতেন, তাই তারা  ঘুমিয়ে নিতেন। ৫ম শতাব্দীর, সিডোনিয়াসের চিঠিতে এই প্রথার ইঙ্গিত রয়েছে, "রাতের খাবারের পরের ঘুম সবসময় সামান্য হয়, এবং কখনও কখনও বিরতিহীন থাকে"।

দুপুরের ঘুম বলতে আমরা অনেকেই মনে করি ১–২ ঘণ্টার দীর্ঘ ঘুম। কিন্তু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সেটি প্রয়োজনীয় তো নয় ই,বরং অনেক সময় ক্ষতিকরই হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে,সবচেয়ে কার্যকর হলো ১০ থেকে ২০ মিনিটের ছোট ঘুমই। এই সময়টুকুতে মস্তিষ্ক গভীর ঘুমের স্তরে প্রবেশ করে না। ফলে  ঘুম ভাঙার পর মাথা ঝিমঝিম করে না। শরীর ভারী লাগে না। কাজের ছন্দ ভেঙে যায় না। এই ছোট ঘুম মূলত মস্তিষ্ককে সাময়িক বিশ্রাম দেয়। অনেকটা কম্পিউটার রিস্টার্ট এর মত,ডেটা মুছে না গিয়ে শুধু সিস্টেমটা ফ্রেশ হয়ে ওঠে।
 

১৫ মিনিটের ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্ক পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় না। এটি এমন একটি অবস্থায় যায়, যেখানে অতিরিক্ত স্নায়বিক চাপটা শুধু কমে আসে। সকালে টানা কাজ করার ফলে মস্তিষ্কের যে অংশগুলো সিদ্ধান্ত নেওয়া, মনোযোগ ধরে রাখা ও তথ্য প্রক্রিয়াকরণের দায়িত্বে থাকে, সেগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ছোট ঘুম সেই ক্লান্ত স্নায়ুকোষগুলোকে পুনরায় সক্রিয় হতে সহায়তা করে। ফলে ঘুম থেকে উঠে মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়ে, প্রতিক্রিয়ার গতি উন্নত হয়, ভুল করার প্রবণতা কমে। বিশেষ করে যেসব কাজে দীর্ঘ সময় মনোযোগ দরকার, যেমন- লেখা, পড়াশোনা, বিশ্লেষণ বা সৃজনশীল চিন্তা, সেখানে এই প্রভাব বেশি স্পষ্ট।

মনোযোগ বাড়ার পাশাপাশি ছোট ঘুম স্মৃতিশক্তির ওপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। দিনের প্রথম ভাগে আমরা যে তথ্য গ্রহণ করি, সেগুলো মস্তিষ্কে জমা হয় অস্থায়ীভাবে। ছোট ঘুম সেই তথ্যগুলোকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করে। ফলে দুপুরের ঘুমের পর নতুন তথ্য শেখা সহজ হয়, আগের শেখা বিষয় মনে রাখতে সুবিধা হয় এবং মানসিক বিভ্রান্তি কমে। এ কারণেই দেখা যায়, শিক্ষার্থী বা মানসিক শ্রমে যুক্ত মানুষের জন্য দুপুরের ছোট ঘুম অতীব উপযোগী।
 

মনোযোগ শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয় নয়। এটি আবেগের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত। মানসিক চাপ, বিরক্তি বা অস্থিরতা বাড়লে মনোযোগ ভেঙে যায়। ১৫ মিনিটের ঘুম মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী অংশকে শান্ত করতে সাহায্য করে। এই বিশ্রামের ফলে-

⇨ অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা কমে

⇨ বিরক্তি ও অধৈর্যতা হ্রাস পায়

⇨ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আবেগ কম প্রভাব ফেলে

⇨ অফিস বা কর্মক্ষেত্রে যেখানে ছোট সিদ্ধান্তও বড় প্রভাব ফেলতে পারে, সেখানে এই মানসিক স্থিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
 

সাধারণভাবে বেশিরভাগ মানুষই ১৫ মিনিটের ঘুম থেকে উপকার পেতে পারেন।তবে ব্যক্তিভেদে পার্থক্যও রয়েছে। যাদের রাতে পর্যাপ্ত ঘুম হয় না, তাদের ক্ষেত্রে এই ছোট ঘুম সাময়িক স্বস্তি দেয়, কিন্তু এটি রাতের ঘুমের বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনা । আবার যারা খুব হালকা ঘুমের মানুষ, তারা দুপুরে ঘুমালে সন্ধ্যার দিকে ঘুমাতে সমস্যায় পড়তে পারেন। তাই সময় নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত দুপুর ৩টার পর ঘুমালে,তা  রাতে ঘুমের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।


 

সঠিকভাবে ১৫ মিনিটের ঘুম নেওয়ার কৌশল:

এই ঘুম থেকে সর্বোচ্চ উপকার পেতে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি-

⇨ ঘুমের সময় খুব দীর্ঘ করা যাবে না। অ্যালার্ম ব্যবহার করলে ভালো হয়।

⇨ আলো কম ও শান্ত পরিবেশ বেছে নেওয়া দরকার।

⇨ বিছানায় নয়, হালকা আরামদায়ক স্থানে বিশ্রাম নিলেই যথেষ্ট।

⇨ ঘুমের আগে ফোন বা স্ক্রিন এড়িয়ে চলা ভালো।

এই অভ্যাসকে নিয়মিত করলে মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে এতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
 

আমাদের সমাজে কাজের মাঝখানে ঘুমকে এখনও অনেক সময় নেতিবাচক ভাবেই দেখা হয়। মনে করা হয়, সারাদিন কাজ করতে হলে বিশ্রাম নেওয়া দুর্বলতা বা অলসতার লক্ষণ। কিন্তু বাস্তবতা ঠিক উল্টো। দীর্ঘ সময় ক্লান্ত অবস্থায় কাজ করলে উৎপাদনশীলতা কমে, ভুল বাড়ে এবং মানসিক চাপ জমতে থাকে। বিজ্ঞান বলছে, কাজের মান ও মনোযোগ বাড়াতে বিশ্রাম গুরুত্বপূর্ণ। ১৫ মিনিটের ঘুম সেই বিশ্রামেরই একটি কার্যকর রূপ, যা সময় নষ্ট করে না, বরং সময়কে আরও ফলপ্রসূ করে তোলে।

দুপুরে  ঘুম তাই কোনো বিলাসিতা নয়, কোনো অলসতার চর্চাও নয়। এটি মস্তিষ্কের স্বাভাবিক চাহিদার প্রতি সম্মান দেখানোর একটি উপায়। সঠিকভাবে নেওয়া হলে এই ছোট ঘুম মনোযোগ বাড়ায়, মানসিক চাপ কমায় এবং দিনের বাকি সময়টুকু আরও কার্যকর করে তোলে।

ব্যস্ত জীবনে হয়তো আমরা দীর্ঘ বিশ্রামের সুযোগ পাই না। কিন্তু মাত্র ১৫ মিনিট সময়টুকু যদি সচেতনভাবে কাজে লাগানো যায়, তাহলে সেটিই হয়ে উঠতে পারে মনোযোগ ধরে রাখার মূক কিন্তু প্রভাবশালী কৌশল। শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা তাই ঘুমানো উচিত কি না,তা নয়। প্রশ্নটা হলো, আমরা কি নিজের মস্তিষ্ককে ঠিক সময়টুকু বিশ্রাম দিতে রাজি! 

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ