নতুন চুল গজানোর নেপথ্য স্ক্যাল্প ম্যাসাজ ও এসেনশিয়াল অয়েল কি সত্যিই কাজ করে?

নতুন চুল গজানোর নেপথ্য স্ক্যাল্প ম্যাসাজ ও এসেনশিয়াল অয়েল কি সত্যিই কাজ করে?
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

একজন মানুষের সৌন্দর্য অনেকাংশেই তার চুলের উপর নির্ভর করে। চুল সুন্দর হলে একজন মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য অনেকটাই বেড়ে যায়। মানুষ যখন থেকে ফ্যাশন বা সৌন্দর্য সর্ম্পকে বুঝতে শেখে তখন থেকেই চুলের প্রতি তার আগ্রহ বেড়ে যায়। রূপকথার রাজকন্যার মতো ঘন, কালো, ঝলমলে সুন্দর চুল পেতে মানুষ কত কি ই বা না করে। সিরাম, জেল,তেল,প্যাক ইত্যাদি আরও কত কি আয়োজন! একটু ভাবুন তো এসবের মাঝেও যদি সাধের চুলটা পড়তে শুরু করে তবে তো সকল পরিশ্রমই মাটি !

তবে চুল পড়া এখন যেন আমাদের কাছে একটি ডাল ভাত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, শুধু সৌন্দর্যের বিপর্যয়ই  নয়, এটি আত্মবিশ্বাস, মানসিক চাপ এবং জীবনযাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে। অল্প বয়সেই চুল পাতলা হয়ে যাওয়া, চুলের গোড়া দুর্বল হওয়া কিংবা ধীরে ধীরে টাকের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আজ শহর থেকে গ্রাম, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই কমন বাস্তবতা। এই প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক সময়ে একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে, স্ক্যাল্প ম্যাসাজ ও এসেনশিয়াল অয়েল কি সত্যিই চুল গজাতে সাহায্য করে, নাকি এটি কেবল লোকজ বিশ্বাস? বৈজ্ঞানিক গবেষণা, স্নায়ুবিজ্ঞান ও ত্বক-শারীরবৃত্তের বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় “হ্যাঁ” বা “না” নয়। বরং সঠিক পদ্ধতি, নিয়মিত চর্চা এবং বাস্তবসম্মত প্রত্যাশা থাকলে স্ক্যাল্প ম্যাসাজ ও নির্দিষ্ট এসেনশিয়াল অয়েল চুলের স্বাস্থ্যে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখতে পারে।

চুল মূলত একটি স্তরবিন্যস্ত স্কোয়ামাস কেরাটিনযুক্ত এপিথেলিয়াম,যা মূলত বহুস্তর বিশিষ্ট সমতল কোষ দিয়ে গঠিত। এসব কোষের দড়ির মতো কেরাটিন ফিলামেন্ট, চুলের শ্যাফটকে গঠন ও দৃঢ়তা দিয়ে থাকে। আমাদের চুলের প্রধান উপাদান হলো কেরাটিন নামের প্রোটিন এবং এটিই চুলের বৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে সক্রিয় রাখে। চুল একটি নির্দিষ্ট বৃদ্ধি-চক্র অনুসরণ করে, যার তিনটি স্বতন্ত্র ও সমান্তরাল ধাপ রয়েছে- অ্যানাজেন, ক্যাটাজেন ও টেলোজেন। প্রতিটি ধাপের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা চুলের দৈর্ঘ্য ও স্থায়িত্ব নির্ধারণ করে।

 

চুল পড়ার মূল সমস্যা কোথায়?

চুলের বৃদ্ধি মূলত স্ক্যাল্প বা মাথার ত্বকের অবস্থার ওপর নির্ভর করে। প্রতিটি চুল একটি ফলিকল থেকে জন্ম নেয়। আর সেই ফলিকল বেঁচে থাকে রক্তপ্রবাহ, অক্সিজেন ও পুষ্টির ওপর নির্ভর করে। আধুনিক জীবনে দীর্ঘসময় মানসিক চাপ, ঘুমের ঘাটতি, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ও দূষণের কারণে স্ক্যাল্পে রক্তপ্রবাহ কমে যায়। ফলিকল তখন ধীরে ধীরে হয়ে পড়ে দুর্বল। এ অবস্থায় বাহ্যিক কোনো উপায় যদি স্ক্যাল্পে রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে পারে এবং স্নায়বিক চাপ কমাতে পারে, তবে তা চুলের বৃদ্ধির জন্য সহায়ক হতে পারে। এখানেই সামনে আসে স্ক্যাল্প ম্যাসাজের প্রয়োজনীয়তা ।
 

স্ক্যাল্প ম্যাসাজ: স্ক্যাল্প ম্যাসাজ মানে জোরে জোরে মাথা চেপে ধরা নয়।এটি একটি নিয়ন্ত্রিত এবং ছন্দময় স্পর্শ। এটি মাথার ত্বকের নিচে থাকা রক্তনালিগুলোকে সক্রিয় করে তোলে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত স্ক্যাল্প ম্যাসাজ, স্ক্যাল্পের ত্বককে সামান্য প্রসারিত করে। ফলে চুলের ফলিকলগুলোতে রক্ত ও পুষ্টি পৌঁছানো সহজ হয়।এর পাশাপাশি ম্যাসাজ স্নায়ুতন্ত্রের ওপরও প্রভাব ফেলে। মাথার ত্বকে অসংখ্য স্নায়ু রয়েছে, যেগুলো উদ্দীপ্ত হলে শরীরে শিথিলতার সংকেত পাঠায়। ফলে কর্টিসল নামের স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা কমে। স্ট্রেস কমা মানেই, চুল পড়ার একটি বড় কারণ নিয়ন্ত্রণে আসা।
 

ম্যাসাজের প্রভাবকাল:

বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বলছে, প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ মিনিটের স্ক্যাল্প ম্যাসাজই যথেষ্ট। এতে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগের প্রয়োজন নেই। আঙুলের ডগা দিয়ে হালকা বৃত্তাকারে পুরো স্ক্যাল্প জুড়ে ম্যাসাজ করলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। তবে এটি কিন্তু কোনো তাৎক্ষণিক সমাধান নয়। চুলের বৃদ্ধির চক্র বেশ ধীরগতির। সাধারণত কয়েক সপ্তাহ বা মাস ধরে নিয়মিত ম্যাসাজ করলে ফলিকলের কার্যকারিতায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

এসেনশিয়াল অয়েল: বিভিন্ন এসেনশিয়াল অয়েল আমরা প্রাচীনকাল থেকেই সৌন্দর্যচর্চার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে আসছি। এসেনশিয়াল অয়েলকে অনেকেই শুধুই সুগন্ধির উৎস হিসেবে দেখেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এগুলো উদ্ভিদ থেকে নিষ্কাশিত অত্যন্ত ঘন সক্রিয় উপাদান। সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এগুলো স্ক্যাল্পের  ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। এসেনশিয়াল অয়েলের ঔষধিগুণ স্ক্যাল্পে রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে সাহায্য করে, কিছু অয়েল ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাল সমস্যা কমাতে ভূমিকা রাখে, আবার কিছু তেল প্রদাহ কমায়। এই সবগুলোই চুলের বৃদ্ধির সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে দেয়। ফলে চুল পড়া কমে, চুলের গোড়া হয় মজবুত পাশাপাশি  নতুন চুল গজানোর জন্যও দারুন ভাবে কাজে দেয়। 
 

কোন এসেনশিয়াল অয়েল কেন প্রয়োগ করা হয়?

◑ রোজমেরি অয়েল স্ক্যাল্পে রক্তপ্রবাহ বাড়াতে বেশ পরিচিত। এটি ফলিকলকে দীর্ঘ সময় সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে।

◑ পিপারমিন্ট অয়েল ব্যবহারে স্ক্যাল্পে হালকা শীতল অনুভূতি হয়, যা স্নায়ু উদ্দীপিত করে এবং রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়।

◑ ল্যাভেন্ডার অয়েল মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক, ফলে স্ট্রেস-জনিত চুল পড়া নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে।

◑ টি ট্রি অয়েল স্ক্যাল্প পরিষ্কার রাখতে সহায়তা করে, বিশেষ করে খুশকি বা ফাঙ্গাল সমস্যার ক্ষেত্রে।

 

তবে এই তেলগুলো কখনোই সরাসরি ব্যবহার করা উচিত নয়।এগুলো সবসময় কোনো বাহক বা বেস তেলের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে হয়।

বাহক তেল : নারিকেল তেল, জোজোবা তেল বা অলিভ অয়েলের মতো বাহক বা বেস তেল এসেনশিয়াল অয়েলকে নিরাপদ করে তোলে। এগুলো স্ক্যাল্পে আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং এসেনশিয়াল অয়েলের সক্রিয় উপাদান ধীরে ধীরে শোষিত হতে দেয়। সাধারণভাবে কয়েক ফোঁটা এসেনশিয়াল অয়েল এক টেবিল চামচ বাহক তেলের সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করা নিরাপদ বলে ধরা হয়। এতে স্ক্যাল্পে জ্বালাপোড়া বা অ্যালার্জির ঝুঁকি কমে।
 

নিয়মিত ব্যবহার করলে কী ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়?

স্ক্যাল্প ম্যাসাজ ও এসেনশিয়াল অয়েল নিয়মিত ব্যবহারে প্রথমে যে পরিবর্তনটি চোখে পড়ে, তা হলো স্ক্যাল্পের আরাম ও স্বাস্থ্য। খুশকি কমে, চুলের গোড়া তুলনামূলকভাবে শক্ত লাগে। এরপর ধীরে ধীরে চুল পড়ার হার কমতে শুরু করতে পারে। নতুন চুল গজানো একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তাই এখানে ধৈর্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হঠাৎ ফল আশা করলে হতাশা তৈরি হতে পারে, যা আবার চুল পড়ার একটি মানসিক কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

 

কারা সতর্ক থাকবেন?

যাদের স্ক্যাল্পে ত্বকের জটিল সমস্যা রয়েছে, যেমন দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ বা তীব্র অ্যালার্জি, তাদের ক্ষেত্রে যেকোনো তেল ব্যবহারের আগে সতর্কতা জরুরি। তাছাড়া, হরমোনজনিত বা জেনেটিক কারণে চুল পড়লে কেবল ম্যাসাজ ও তেলই যথেষ্ট নাও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্ক্যাল্প ম্যাসাজ ও এসেনশিয়াল অয়েলকে একমাত্র সমাধান হিসেবে বিবেচনা না করে সহায়ক পদ্ধতি হিসেবে দেখা উচিত।

একসময় স্ক্যাল্প ম্যাসাজ ও তেল ব্যবহারকে নিছক ঘরোয়া টোটকা হিসেবে মনে করা হতো। কিন্তু আধুনিক গবেষণা দেখাচ্ছে, এই পদ্ধতিগুলোর পেছনে বাস্তব শারীরবৃত্তীয় বিশ্লেষণ রয়েছে। তবে বিজ্ঞান এটাও স্পষ্ট করেছে যে সব সমস্যার সমাধান এক জায়গায় নেই। চুলের স্বাস্থ্য মানে কেবল বাহ্যিক যত্ন নয়, এর সঙ্গে জড়িত খাদ্যাভ্যাস, ঘুম, মানসিক চাপ ও সামগ্রিক জীবনযাপন।

স্ক্যাল্প ম্যাসাজ ও এসেনশিয়াল অয়েল কোনো জাদুকরী চিকিৎসা তো নয়, কিন্তু নিয়মিত, সঠিক ও সচেতন ব্যবহারে এগুলো চুলের বৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারে। চুল গজানো সময়ের ব্যাপার। আর সেই সময়টুকু যদি যত্ন, ধৈর্য ও বাস্তব জ্ঞানের সঙ্গে কাটানো যায়, তবে ফল শুধু চুলেই নয়, আত্মবিশ্বাসেও ফুটে উঠে।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ