শ্বাসেই শান্তি আর ধ্যানে স্থিরতা-৫ মিনিটে মানসিক চাপ কমানোর শক্তিশালী ট্রিক!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
-
দ্রুতগামী, প্রযুক্তিনির্ভর জীবনধারায় মানসিক চাপ বা স্ট্রেস যেন আমাদের সঙ্গে একদম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে। অফিস, পড়াশোনা, পারিবারিক দায়িত্ব, সামাজিক চাপ সব মিলিয়ে মানুষের মন ও শরীর প্রায়ই হয়ে থাকে উত্তেজিত। দীর্ঘ সময় ধরে এই চাপ শুধু মানসিক অসুবিধা সৃষ্টি করে না, বিভিন্ন শারীরিক অসুখের কারণও হয়ে ওঠে। গবেষণা দেখিয়েছে, দীর্ঘমেয়াদী স্ট্রেস হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হজমজনিত সমস্যা, ঘুমের ব্যাঘাত এবং মনোযোগের কমতি ঘটাতে পারে। এক্ষেত্রে প্রমাণিত, কার্যকরী এবং সহজ পদ্ধতি হলো শ্বাসপ্রশ্বাস ও ধ্যান, মনের পাশাপাশি, শরীরের স্নায়ুতন্ত্রকে স্থিতিশীলও শান্ত করে, রক্তচাপ রাখে নিয়ন্ত্রণে এবং মস্তিষ্ককে করে পুনরুজ্জীবিত। এই দুটি কৌশল মানুষের প্রাকৃতিক শান্তি ও শক্তি ফিরিয়ে আনার জন্য শতাব্দীর পুরনো প্রক্রিয়া হলেও আধুনিক বিজ্ঞান তাদের প্রভাব সনদ দিয়েছে।
মানুষের শরীর স্বাভাবিকভাবে স্ট্রেস রেসপন্স বা লড়াই-বা-পালানোর প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে থাকে। বিপদ বা চাপের মুহূর্তে অ্যাড্রিনালিন, কর্টিসল এবং অন্যান্য স্ট্রেস হরমোন নিঃসৃত হয়। ফলে হৃদস্পন্দন দ্রুত বেড়ে যায়, রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়, পেশী টানাপোড়েন হয় এবং মস্তিষ্ক অতিসক্রিয় থাকে। প্রকৃত বিপদের সময় এই প্রতিক্রিয়া সহায়ক। কিন্তু আজকের জীবনে বিপদ আসলে বাস্তব নয়, দৈনন্দিন চাপের কারণে এই সিস্টেম সক্রিয় হতে থাকে বারবার । দীর্ঘমেয়াদে এটি শরীরকে ক্লান্ত করে, মনকে উদ্বিগ্ন করে এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলে। শ্বাসপ্রশ্বাস এবং ধ্যান এই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণে আনার একটি উপযুক্ত উপায়। সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত রাখা সম্ভব, স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা কমানো যায় এবং মস্তিষ্ক পুনরায় কার্যক্ষম হয়।
শ্বাসপ্রশ্বাস:
আমরা সরাসরি আমাদের parasympathetic nervous system বা শিথিলকরণ সিস্টেম সক্রিয় করতে পারি, শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে। গভীর ও নিয়ন্ত্রিত শ্বাস মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি করে, হৃদস্পন্দন কমায় এবং স্ট্রেস হরমোন হ্রাস করে। গবেষণার তথ্যানুসারে, ধীরে শ্বাস নেওয়া ও ছাড়ার মাধ্যমে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা অনেকটা কমে যায়। ফলে রক্তচাপ এবং হৃৎপিণ্ডের চাপও হ্রাস পায়। মন শান্ত থাকে, চিন্তা স্পষ্ট হয় এবং মানসিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।
সহজ চর্চা পদ্ধতি :
◑ শান্তভাবে বসে বা শুয়ে চোখ বন্ধ করুন।
◑ নাক দিয়ে ধীরে ধীরে ৪ সেকেন্ড ধরে শ্বাস নিন।
◑ শ্বাস ধরে রাখুন ৪ সেকেন্ড।
◑ মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে ৪ সেকেন্ড ধরে শ্বাস ছাড়ুন।
এই প্রক্রিয়াটি ৫–১০ মিনিট করতে থাকুন। অনুশীলনের পর পরই মন শান্ত, শরীর হালকা এবং মানসিক চাপ কমে যাওয়া অনুভব করা যায়।
ধ্যান:
ধ্যান বা meditation হল মনের বর্তমান মুহূর্তে স্থির রাখার এক কার্যকর প্রক্রিয়া। মননশীলতা বা জ্ঞানীয় দক্ষতা সাধারণত ধ্যানের মাধ্যমেই বিকশিত হয়।
১৯৭০ সাল থেকে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান ও মনোরোগ ধ্যান মস্তিষ্কের কাঠামো ও কার্যকারিতায়
আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে নিয়মিত উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনে।
ধ্যানের উপকারিতা:
⇨ মস্তিষ্কের prefrontal cortex সক্রিয় হয়, যা মনোযোগ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
⇨ Amygdala, যা ভয় ও উদ্বেগের জন্য দায়ী, তার কার্যকারিতা হ্রাস পায়।
⇨ স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা কমে যায়।
⇨ দীর্ঘমেয়াদে স্মৃতিশক্তি ও মানসিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।
সহজ অনুশীলন পদ্ধতি :
◑ শান্ত স্থানে বসুন বা শুয়ে চোখ বন্ধ করুন।
◑ শ্বাসপ্রশ্বাসে মনোনিবেশ করুন। শ্বাস নেওয়া এবং ছাড়ার ধরণ অনুভব করুন।
◑ মন অস্থির বা বিচ্যুত হলে, নিজেকে দমন না করে ধীরে ধীরে শ্বাসের দিকে ফেরান।
◑ শুরুতে ৫ মিনিট থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে ২০–৩০ মিনিটে ঊর্ধ্বতন করুন।
ধ্যান কিন্তু শুধু মানসিক চাপই কমায় না। এটি সৃজনশীলতা, সমস্যার সমাধান ক্ষমতা এবং মানসিক স্থিতিশীলতাও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করে ।
শ্বাসপ্রশ্বাস ও ধ্যান একত্রিত করলে প্রভাব হয় দ্বিগুণ। প্রথমে ৫ মিনিট গভীর শ্বাসের মাধ্যমে শরীরকে শান্ত করা যায়। এরপর ১০–১৫ মিনিট ধ্যানের মাধ্যমে মনকে বর্তমান মুহূর্তে স্থির রাখা সম্ভব। এভাবে শরীর এবং মস্তিষ্ক উভয়ই পুনরায় সংযুক্ত হয়। সারাদিনের চাপ, উদ্বেগ ও হতাশা দূর হয়ে আসে।
দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ:
⇨ কাজের ফাঁকে: অফিসের ডেস্কে ৫–১০ মিনিট গভীর শ্বাস বা মাইন্ডফুল ধ্যান।
⇨ ঘুমের আগে: ১০–১৫ মিনিট শ্বাসপ্রশ্বাস ও ধ্যান ঘুমের মান উন্নত করে।
⇨ স্ট্রেসপূর্ণ মুহূর্তে: কোনো বিতর্ক, পরীক্ষা বা গুরুত্বপূর্ণ কাজের আগে দ্রুত চাপ কমাতে সাহায্য করে।
⇨ সৃজনশীল কাজের সময়: চিন্তার জটিলতা কমায়, মনোযোগ বাড়ায়।
শ্বাসপ্রশ্বাস ও ধ্যান কোনো সরঞ্জাম বা অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন নেই। শুধু নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা যথেষ্ট।
ধ্যান মস্তিষ্কের নিউরোপ্লাস্টিসিটি বাড়ায়। এটি মানে, মস্তিষ্ক নতুন অভ্যাস ও চিন্তাভাবনা শিখতে সক্ষম হয়। নিয়ন্ত্রিত শ্বাসপ্রশ্বাস এবং ধ্যান কর্টিসল হরমোন হ্রাস করে, যা দীর্ঘমেয়াদী স্ট্রেসের ক্ষতি কমায়। গবেষণা দেখিয়েছে, নিয়মিত ধ্যান বিষণ্নতা, উদ্বেগ এবং মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন নিয়ন্ত্রণ, রক্তচাপ হ্রাস, শ্বাসনালী ও পেশী শিথিলকরণ সবই শ্বাসপ্রশ্বাস ও ধ্যানের মাধ্যমে সম্ভব।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ:
স্নায়ুবিজ্ঞানীরা ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সবাই একমত যে, শ্বাসপ্রশ্বাস ও ধ্যান নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করলে স্ট্রেসের শারীরিক ও মানসিক প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে কমে। এটি দীর্ঘমেয়াদে জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করে এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও শক্তিশালী করে।
শ্বাসপ্রশ্বাস ও ধ্যান হলো প্রাচীন কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত কৌশল। আজকের ব্যস্ত ও চাপপূর্ণ জীবনে এই কৌশলগুলোকে নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করলে, শুধু মানসিক প্রশান্তি নয়, শরীরের স্বাভাবিক কার্যকারিতা এবং মানসিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।