ঘুমের আগে ফোনের ব্যবহার? অজান্তেই কি মস্তিষ্কের ‘রিপেয়ারিং সিস্টেম’বন্ধ করে ফেলছি আমরা!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
-
রাতে ঘুমানোর ঠিক আগেও শেষবারের মতো ফোনটা আবার হাতে নেওয়ার অভ্যাসটি এখন আর আলাদা কোনো প্রজন্মের নয়, বরং প্রায় সবারই দৈনন্দিন রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম স্ক্রল করেন, কেউ ভিডিও দেখেন, কেউ বা কাজের মেসেজের জবাব দেন, কেউ আবার ‘মাত্র পাঁচ মিনিট’ বলে শুরু করে কখন যে এক ঘণ্টা কেটে যায়, তা টেরই পান না।
কিন্তু এই সামান্য মনে হওয়া অভ্যাসের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক গভীর ও নীরব বিপদ। এতে মস্তিষ্কের নিজস্ব রিপেয়ারিং সিস্টেম থমকে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানের ভাষায়, মানুষের মস্তিষ্ক সারাদিনের মানসিক চাপ, তথ্যের ভার, সিদ্ধান্তের ক্লান্তি ও স্নায়বিক ক্ষয় থেকে নিজেকে মেরামত করে রাতের ঘুমের সময়। এই সময়টাতেই সক্রিয় হয় মস্তিষ্কের স্বাভাবিক পরিষ্কার ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়া। কিন্তু রাতের অন্ধকারে ফোনের উজ্জ্বল আলো, নোটিফিকেশনের শব্দ আর উত্তেজনাপূর্ণ কনটেন্ট সেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
মস্তিষ্কের ‘রিপেয়ারিং সিস্টেম’ আসলে কী?
মানুষের মস্তিষ্ককে অনেকটা একটি ব্যস্ত শহরের সঙ্গে তুলনা করা যায়। সারাদিন শহরে যানজট,শব্দ, ধোঁয়া, আবর্জনা জমে। আবার সারাদিন শেষে রাত গভীর হলে যখন যানবাহন কমে যায় আর শুরু হয় রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া, বর্জ্য সরানো, ক্ষতিগ্রস্ত জায়গা মেরামত করা ইত্যাদি শহর পরিষ্কারের কাজগুলো। মস্তিষ্কেও কিছুটা এমনই একটি ব্যবস্থা রয়েছে। ঘুমের গভীর পর্যায়ে মস্তিষ্কের ভেতরে স্নায়ুকোষগুলোর মাঝখানে থাকা ফাঁকা জায়গা সাময়িকভাবে একটু প্রসারিত হয়। এর ফলে দিনের বেলা জমে থাকা অপ্রয়োজনীয় রাসায়নিক বর্জ্য, অতিরিক্ত প্রোটিন ও ক্লান্তির চিহ্নগুলো ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে পারে। একই সঙ্গে স্মৃতি সংরক্ষণ, শেখা তথ্যগুলো গুছিয়ে নেওয়া, আবেগ নিয়ন্ত্রণের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা—সবকিছুই ঘটে এই সময়টাতে। এই পুরো প্রক্রিয়াই অনেকটা মস্তিষ্কের ‘রিপেয়ারিং সিস্টেম’। কিন্তু এই সিস্টেম কাজ করতে পারে এক শর্তে আর তা হলো গভীর ও নিরবচ্ছিন্ন ঘুম।
ফোনের আলো কীভাবে এই সিস্টেমে বাধা দেয়?
রাতে ফোন ব্যবহারের সবচেয়ে বড় সমস্যা কেবল সময় নষ্টই নয়,আলো ও মানসিক উত্তেজনার সম্মিলিত প্রভাবও । স্মার্টফোন, ট্যাবলেট বা ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে নির্গত আলো মস্তিষ্ককে দিন শেষ হয়নি বার্তা দেয়। মানুষের শরীরে একটি স্বাভাবিক জৈবিক ঘড়ি আছে, যা আলো-অন্ধকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। সন্ধ্যার পর অন্ধকার বাড়লে শরীর ধীরে ধীরে ঘুমের প্রস্তুতি নেয়। এই সময় মস্তিষ্ক একটি বিশেষ হরমোন নিঃসরণ করে, যা শরীরকে জানিয়ে দেয়, এখন বিশ্রামের সময়। কিন্তু ফোনের উজ্জ্বল আলো সেই বার্তাটিকে গুলিয়ে দেয়। ফলে মস্তিষ্ক ঘুমের গভীর পর্যায়ে যেতে দেরি করতে থাকে। কখনো কখনো গেলেও সেই ঘুম হয় ভাঙাচোরা ও অগভীর। আর গভীর ঘুম না হলে মস্তিষ্কের রিপেয়ারিং সিস্টেমও পুরোপুরি সক্রিয় হতে পারে না।
রাতে ফোন ব্যবহারের আরেকটি বড় সমস্যা হলো কনটেন্টের ধরন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্ট, খবরের শিরোনাম, ভিডিও বা বার্তা এসবের বেশিরভাগই মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে। আনন্দ, রাগ, ভয়, কৌতূহল, একাধিক আবেগ একসঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঘুমের আগে যখন মস্তিষ্কের কাজ হওয়া উচিত ধীরে ধীরে শান্ত হওয়া, তখন ফোনের কনটেন্ট উল্টো তাকে আরও সক্রিয় করে ফেলে। যার ফলে মস্তিষ্ক বিশ্রাম মোডে যেতে পারে না। এতে রিপেয়ারিং সিস্টেম অপেক্ষমাণ অবস্থায় থেকে যায়, অথবা পুরোপুরি বন্ধই থাকে।
এক-দুই রাত কম ঘুম হলে হয়তো বড় তেমন কিছু ঘটে না। কিন্তু অনেকদিন ধরে মস্তিষ্ক যদি নিয়মিতভাবে নিজের মেরামতের সুযোগ না পায়, তাহলে তার প্রভাব ধীরে ধীরে জমতে থাকে।
প্রথম দিকে শুধু সকালে ঘুম ভাঙার পরও ক্লান্তি দেখা দিতে পারে। এছাড়া মনোযোগ ধরে রাখতে সমস্যা, ছোটখাটো ভুল বেড়ে যাওয়া, আবেগ নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা ইত্যাদি সমস্যাও দেখা দিতে পারে এবং সময় গড়ালে এর প্রভাব আরও গভীর হতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে আবার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া বা অকারণ উদ্বেগও বাড়তে পারে। কারণ মস্তিষ্ক প্রতিদিন যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষয় সয়ে নেয়, তা যদি ঠিকমতো মেরামত না হয়, তাহলে সেই ক্ষয় একসময় বড় আকার ধারণ করে।
শিশু ও কিশোরদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরও বেশি।
রাতে ফোন ব্যবহারের বিষয়টি শিশু ও কিশোরদের ক্ষেত্রে আরও বেশি আশঙ্কাজনক। এই বয়সে মস্তিষ্ক এখনো গঠন ও পরিণতির মধ্য দিয়ে যায়। শেখা, স্মৃতি, আবেগ ও আচরণ নিয়ন্ত্রণ সবকিছুই তখন বিকাশমান। এই সময় নিয়মিতভাবে গভীর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। মনোযোগের সমস্যা, পড়াশোনায় আগ্রহ কমে যাওয়া, অতিরিক্ত উত্তেজনা বা বিষণ্নতা এসব ঝুঁকি বাড়তে পারে। তাই বিষয়টি কেবল ব্যক্তিগত অভ্যাস নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত।
তবে আমাদের বাস্তব জীবনে ফোন একেবারে বাদ দেওয়া প্রায় অসম্ভব। কাজ, যোগাযোগ, জরুরি তথ্য সবকিছুতেই এখন স্মার্টফোনের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সমস্যার মূল জায়গাটি হলো সময় ও পদ্ধতি ।
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে কিছু অভ্যাসের পরিবর্তনই বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে-
⇨ ঘুমানোর অন্তত এক ঘণ্টা আগে ফোন ব্যবহার বন্ধ করা। এই সময়টাতে আলো কমিয়ে, শান্ত পরিবেশ তৈরি করে শরীরকে ধীরে ধীরে বিশ্রামের জন্য প্রস্তুত করা।
⇨ রাতে ফোন ব্যবহার করতেই হলে স্ক্রিনের উজ্জ্বলতা কমানো এবং উত্তেজনাপূর্ণ কনটেন্ট এড়িয়ে চলা।
⇨ ঘুমানোর সময় ফোনটি বিছানা থেকে কিছুটা দূরে রাখা, যাতে নোটিফিকেশন বা আলো সরাসরি মনোযোগ কেড়ে না নেয়।
এই ছোট পরিবর্তনগুলোই মস্তিষ্ককে তার প্রাকৃতিক রিপেয়ারিং সিস্টেমে ফেরার সুযোগ করে দিতে পারে।
প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে সহজ করেছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রযুক্তির ব্যবহার যদি শরীর ও মস্তিষ্কের প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে তার মূল্যও দিতে হয় নীরবে। রাতে ফোন ব্যবহারের অভ্যাস ঠিক তেমনই একটি নীরব ঝুঁকি, যা ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ছন্দ ভেঙে দিতে পারে।মস্তিষ্ক সারাদিন কাজ করে, সিদ্ধান্ত নেয়, অনুভব করে এবং শিখে। রাতে সে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে চায়, পরিষ্কার করতে চায় দিনের জঞ্জালগুলো। সেই সময় যদি আমরা নিজেরাই আলো জ্বালিয়ে তাকে জাগিয়ে রাখি, তাহলে তার রিপেয়ারিং সিস্টেম বন্ধ হয়ে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।
ঘুমের আগে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকা হয়তো আমাদের কাছে সামান্য একটি অভ্যাস। কিন্তু এর প্রভাব যে মস্তিষ্কের গভীরে গিয়ে পৌঁছায়, তা এখন আর উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। রাতের শেষ আলোটি যদি হয় ফোনের স্ক্রিন, তবে মস্তিষ্কের মেরামতের কাজটি থেকে যেতে পারে অসম্পূর্ণ। আর প্রতিদিনের সেই অসম্পূর্ণতাই একসময় বড় সমস্যার রূপ নিতে পারে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।