ডেইজি: শীতের হিমেল তাপমাত্রাতেও কীভাবে টিকে থাকে এই ফুল?

ডেইজি: শীতের হিমেল তাপমাত্রাতেও কীভাবে টিকে থাকে এই ফুল?
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

শীত নামলেই যেন বাগানের রং ফিকে হয়ে আসতে শুরু করে। কুয়াশা, কম সূর্যালোক আর নিম্ন তাপমাত্রার সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে অনেক ফুল গাছই ঝিমিয়ে পড়ে। কিন্তু ঠিক এই প্রতিকূল সময়েই চোখে পড়ে এক আশ্চর্য দৃশ্য- সাদা, হলুদ কিংবা গোলাপি রঙের ডেইজি ফুল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, ঠান্ডার প্রকোপ তাকে দমাতে পারে না। প্রকৃতির এই নীরব সহনশীলতার নামই ডেইজি। প্রশ্ন হলো ডেইজি ফুল কীভাবে ঠান্ডা সহ্য করে? এর পেছনে কী আছে কোনো ব্যাখ্যা? আর এই ক্ষমতা বাগানপ্রেমীদের জন্যই বা কী বার্তা দেয়?

ডেইজি ,  অ্যাস্টেরেসি বা অ্যাস্টার পরিবারের  অন্তর্গত বিভিন্ন প্রজাতির  উদ্ভিদের যেকোনো একটি। ডেইজি শুধু একটি সৌন্দর্যমণ্ডিত ফুল নয়, এটি একধরনের অভিযোজিত উদ্ভিদ, যার শারীরবৃত্তীয় গঠন ও কোষগত আচরণ ঠান্ডা পরিবেশে টিকে থাকার জন্য বিশেষভাবে কার্যকর। নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলে ডেইজির বিস্তারই প্রমাণ করে এটি শীতের সঙ্গে আপস নয়, বরং শীতকে মোকাবিলা করেই বেঁচে থাকতে শেখে।

ঠান্ডা সহনশীলতা মানে কী?

উদ্ভিদবিজ্ঞানে ঠান্ডা সহনশীলতা বলতে নিম্ন তাপমাত্রায়ও কোষের কার্যকারিতা বজায় রাখা, কোষের ভেতরে বরফ জমে যাওয়ার ক্ষতি এড়ানো এবং বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ থামিয়ে না দিয়ে ধীরগতিতে চালু রাখাকে বোঝায়। ডেইজি এই তিনটি স্তরেই ব্যতিক্রমী। ডেইজি ফুল সাধারণত এমন অঞ্চলে ভালো জন্মায়, যেখানে রাতের তাপমাত্রা হঠাৎ কমে যায়, দিনের আলো সীমিত থাকে এবং মাটির উষ্ণতা দীর্ঘ সময় ধরে কম থাকে। অন্য অনেক ফুল যেখানে এই পরিস্থিতিতে পাতা ঝরিয়ে দেয় বা ফুল দেওয়া বন্ধ করে, ডেইজি সেখানে নিজের জৈব কৌশল কাজে লাগায়।

ডেইজি ফুলের ঠান্ডা সহনশীলতার মূল চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে এর কোষের ভেতরে। ঠান্ডা পড়লে উদ্ভিদের কোষে পানি জমে বরফে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বরফের স্ফটিক কোষপ্রাচীর ভেঙে দিতে পারে, ফলে গাছ মরে যায়। ডেইজি এই বিপদ এড়াতে কোষের ভেতরে দ্রবণীয় শর্করা ও নির্দিষ্ট প্রোটিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এই শর্করা ও প্রোটিন কোষের পানির জমাট বাঁধার তাপমাত্রা কমিয়ে দেয়। ফলে বাইরে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের কাছাকাছি গেলেও কোষের ভেতরের তরল সম্পূর্ণ বরফে পরিণত হয় না। একে বলা যায় প্রাকৃতিক ‘অ্যান্টিফ্রিজ’ ব্যবস্থা।

ডেইজি ফুলের পাতা সাধারণত মাটির খুব কাছাকাছি থাকে এবং রোজেট আকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে। এই গঠনগত বৈশিষ্ট্য ঠান্ডা সহনশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মাটির কাছাকাছি থাকায় পাতাগুলো মাটির উষ্ণতা থেকে সামান্য হলেও তাপ পায়। একই সঙ্গে রোজেট গঠন বাতাসের সরাসরি আঘাত কমায়, ফলে ঠান্ডা বাতাস পাতার ভেতরের আর্দ্রতা দ্রুত কেড়ে নিতে পারে না। পাতার উপরিভাগে থাকা সূক্ষ্ম মোমজাতীয় আবরণও ঠান্ডা প্রতিরোধে সহায়ক। এটি পাতার ভেতরের পানি বাষ্পীভবন কমিয়ে দেয় এবং তাপ ধরে রাখতে সাহায্য করে। শীতের সকালে ডেইজির পাতায় শিশির জমলেও সূর্য উঠলে দ্রুত তা ঝরে যায়। এটিও পাতার বিশেষ গঠন ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের ফল।

ডেইজি ফুলের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, ঠান্ডায় এটি সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে না। বরং বৃদ্ধির গতি কমিয়ে দেয়। এই ধীর বৃদ্ধি গাছের শক্তি সঞ্চয় করতে সাহায্য করে। ডেইজি শীতকালে তার শক্তির বড় অংশ ব্যয় করে শিকড় মজবুত করতে, যাতে বসন্ত এলে দ্রুত ফুল ফোটানো যায়। এই কৌশল অনেকটাই প্রকৃতির সময় ব্যবস্থাপনার মতো। শীতকালে যখন পরাগায়নকারী পোকামাকড় কম থাকে, তখন অতিরিক্ত ফুল দেওয়া অর্থহীন। ডেইজি তাই অপেক্ষা করে, শক্তি জমায়, আর উপযুক্ত সময় এলে বিস্ফোরণের মতো ফুল ফোটায়।

সাধারণত হালকা থেকে মাঝারি ঠান্ডা ডেইজি সহজেই সহ্য করতে পারে। তাপমাত্রা কমলেও যদি মাটি সম্পূর্ণ বরফে জমে না যায়, ডেইজি টিকে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে হালকা তুষারপাতের পরও ডেইজির পাতা ও কুঁড়ি অক্ষত থাকে। তুষার নিজেই এক ধরনের প্রাকৃতিক কম্বল হিসেবে কাজ করে, যা ভেতরের তাপ ধরে রাখে। ডেইজি এই সুবিধা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারে।

ডেইজি ফুলের ঠান্ডা সহনশীলতা শুধু গাছের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে না, মাটির ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। ঝরঝরে, পানি নিষ্কাশনে সক্ষম মাটি ডেইজির জন্য সবচেয়ে উপযোগী। শীতে যদি মাটিতে অতিরিক্ত পানি জমে থাকে, তবে ঠান্ডার সঙ্গে মিলে শিকড় পচে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। ডেইজি এমন মাটিতে ভালো থাকে, যেখানে পানি জমে না থাকে কিন্তু প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা বজায় থাকে।

শীতকালে সূর্যালোকের সময় কমে যায়। ডেইজি এই সীমিত আলোতেও আলোকসংশ্লেষ চালিয়ে যেতে পারে। এর পাতায় থাকা ক্লোরোফিল তুলনামূলকভাবে কম আলোতেও কার্যকর। ফলে ঠান্ডা ও কম আলো  দুই প্রতিকূলতার মাঝেও ডেইজি নিজের খাদ্য উৎপাদন চালু রাখতে পারে।

ডেইজির  অভিযোজন ক্ষমতা ভবিষ্যতের বাগান পরিকল্পনাতেও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। যেসব ফুল কম যত্নে, প্রতিকূল আবহাওয়াতেও টিকে থাকতে পারে, সেগুলো নগরায়নের যুগে আরও বেশি গুরুত্ব পাবে। যারা শীতপ্রধান এলাকায় বা শীতকালে বাগান করতে চান, তাদের জন্য ডেইজি একটি নির্ভরযোগ্য পছন্দ হতে পারে।

ডেইজি ফুলের ঠান্ডা সহনশীলতা কোনো জাদু নয়, এটি প্রকৃতির দীর্ঘ অভিযোজন প্রক্রিয়ার ফল। কোষগত রসায়ন, পাতার গঠন, শিকড়ের কৌশল আর শক্তি ব্যবস্থাপনা  মিলিয়ে ডেইজি শীতের বিরুদ্ধে এক সুসংগঠিত প্রতিরক্ষা গড়ে তুলেছে। শীতের সকালে কুয়াশার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা একটি ডেইজি শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, এটি সহনশীলতার জীবন্ত উদাহরণ। প্রকৃতি যেন ডেইজির মাধ্যমে আমাদেরই মনে করিয়ে দেয়, প্রতিকূলতা এলে ভেঙে পড়া নয়, বরং ধীরে, স্থিরভাবে মানিয়ে নেওয়াই টিকে থাকার আসল কৌশল।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ