মনোমালিন্য? ভুল বোঝাবুঝি? তর্ক নয়, সমাধানের পথে এগোন-শিখুন কার্যকর কৌশল

মনোমালিন্য? ভুল বোঝাবুঝি? তর্ক নয়, সমাধানের পথে এগোন-শিখুন কার্যকর কৌশল
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

সংঘাত মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। পরিবারে মতবিরোধ, কর্মক্ষেত্রে মতের অমিল, সামাজিক বা পেশাগত সম্পর্কে টানাপোড়েন- সবখানেই সংঘাতের উপস্থিতি স্বাভাবিক। কিন্তু সংঘাত নিজে সমস্যা নয়। সমস্যা তখনই তৈরি হয়, যখন তা সঠিকভাবে সামলানো যায় না। আধুনিক সমাজবিজ্ঞান ও আচরণবিজ্ঞানের ভাষায়, সংঘাত ব্যবস্থাপনা মানে দ্বন্দ্ব এড়িয়ে যাওয়া নয়, বরং দ্বন্দ্বকে বোঝা, বিশ্লেষণ করা এবং গঠনমূলক সমাধানে পৌঁছানো। এই প্রতিবেদনটি সেই বাস্তব প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে- সংঘাত কেন হয়! মানুষ কেন ভুল পথে সমাধান খোঁজে! আর কোন কৌশলগুলো সত্যিকার অর্থে সমস্যা সমাধানে কার্যকর!

প্রত্যেক মানুষের চিন্তা, অভিজ্ঞতা, মানসিক গঠন ও অগ্রাধিকার আলাদা। ফলে একই পরিস্থিতিকে সবাই একভাবে দেখে না। এখান থেকেই জন্ম নেয় মতবিরোধ। সংঘাতের সাধারণ উৎসগুলো হলো,

প্রত্যাশা ও বাস্তবতার অমিল, যোগাযোগের ঘাটতি বা ভুল ব্যাখ্যা, ক্ষমতা, দায়িত্ব বা স্বীকৃতি নিয়ে দ্বন্দ্ব, মানসিক চাপ ও ক্লান্তি, ব্যক্তিগত মূল্যবোধের সংঘর্ষ ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞদের মতে, সংঘাত না থাকলে সেটি অনেক সময় সুস্থ সম্পর্কের লক্ষণও নয়। কারণ সংঘাত মানেই মানুষ নিজের অবস্থান প্রকাশ করছে। প্রশ্ন হলো এই প্রকাশ কি ধ্বংসের দিকে যাবে, নাকি সমাধানের দিকে?

অনেকেই মনে করেন, চুপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। সাময়িকভাবে এতে শান্তি এলেও দীর্ঘমেয়াদে এই কৌশল বিপজ্জনক। এড়িয়ে যাওয়ার ফলে অমীমাংসিত ক্ষোভ জমে থাকে। ভুল বোঝাবুঝি গভীর হয় এবং সম্পর্কের ভিত নীরবে দুর্বল হয়। অনেক সময় ভবিষ্যতে সংঘাত আরও তীব্র আকার নিয়ে থাকে। অতএব, সংঘাত ব্যবস্থাপনার প্রথম ধাপ হলো সমস্যাকে অস্বীকার না করে স্বীকার করে নেয়া।

আচরণবিজ্ঞান বলছে, মানুষের প্রতিক্রিয়া সাধারণত পাঁচ ধরনের হয়ে থাকে-

১. এড়িয়ে যাওয়া।
২. জোর করে নিজের মত চাপানো।
৩. অন্যের কাছে পুরোপুরি নতি স্বীকার।
৪. সমঝোতা করা।
৫. সহযোগিতামূলক সমাধান খোঁজা।

এর মধ্যে শেষের দুইটি, বিশেষ করে সহযোগিতামূলক পদ্ধতিই দীর্ঘমেয়াদে সবচেয়ে কার্যকর বলে বিবেচিত।


কার্যকর সংঘাত ব্যবস্থাপনার মূল কৌশলগুলো: 

১.সমাধানের প্রথম শর্ত-  আবেগ নিয়ন্ত্রণ। সংঘাতের সময় আবেগ সবচেয়ে বড় বাধা। রাগ, অপমানবোধ বা হতাশা যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে দেয় না। তাই আলোচনায় বসার আগে নিজেকে মানসিকভাবে স্থির করা জরুরি। গভীর শ্বাস, সময় নেওয়া বা আলোচনার সময় ঠিক করা, এসব ছোট কৌশল আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।

২. কথা বলার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ শোনে শেখা! বেশিরভাগ সংঘাতের মূল কারণ হলো,একপক্ষ কথা বলছে, কিন্তু কেউ শুনছে না। কার্যকর সংঘাত ব্যবস্থাপনায় সক্রিয়ভাবে শোনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মানে মাঝখানে বাধা না দেওয়া। শুধু শব্দ নয়, অনুভূতিও বোঝার চেষ্টা। নিজের উত্তর প্রস্তুত না করে পুরো কথা শোনা। মানুষ যখন বুঝতে পারে যে তাকে শোনা হচ্ছে, তখন প্রতিরোধ স্বাভাবিকভাবেই কমে আসে।

৩. দোষারোপ নয়, সমস্যার দিকে ফোকাস করা। ব্যক্তিকে নয়, আচরণ বা পরিস্থিতিকে চিহ্নিত করা অভিযোগের বদলে প্রভাব ব্যাখ্যা করা। এতে আলোচনার সুর নরম থাকে এবং প্রতিপক্ষ প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে চলে যায় না।

৪. উভয় পক্ষের প্রয়োজন বোঝা। সংঘাতের আড়ালে প্রায়ই লুকিয়ে থাকে কোনো অপূর্ণ চাহিদা, স্বীকৃতি, নিরাপত্তা, সম্মান বা নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা।এই প্রয়োজনগুলো চিহ্নিত করা গেলে সমাধান অনেক সহজ হয়ে যায়। কারণ তখন লক্ষ্য থাকে জয়-পরাজয় নয়, বরং প্রয়োজন পূরণ।

৫. সমাধানে যৌথ অংশগ্রহণ! কার্যকর সমাধান কখনো একতরফা হয় না। উভয় পক্ষ যখন সমাধান তৈরির প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকে, তখন সেটি বাস্তবসম্মত ও গ্রহণযোগ্য হয়। এক্ষেত্রে একাধিক বিকল্প নিয়ে আলোচনা, এবং কোন সমাধান কেন কার্যকর হবে তা বিশ্লেষণ প্রয়োজনে ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা, এই পদ্ধতি সম্পর্কের ভরসা বাড়ায়।

কর্মক্ষেত্রে সংঘাত শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষমতাকেও প্রভাবিত করে। ভুলভাবে সামলালে দলীয় কাজ ব্যাহত হয়। ফলে উৎপাদনশীলতা কমে, মানসিক চাপ বাড়ে। সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করলে নতুন আইডিয়ার জন্ম হয় এবং দলগত বিশ্বাস বাড়ে,পাশাপাশি নেতৃত্বের গুণ বিকশিত হয়।

এ কারণেই আধুনিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংঘাত ব্যবস্থাপনাকে দক্ষতার অংশ হিসেবে দেখছে।


পারিবারিক সংঘাতে আবেগের মাত্রা বেশি থাকে। এখানে যুক্তির পাশাপাশি অনুভূতির মূল্য অনেক বেশি।এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ -সময় নিয়ে কথা বলা পুরনো অভিযোগ টেনে না আনা। ক্ষমা ও ছাড় দেওয়ার মানসিকতা। পরিবারে সংঘাত জয়ের বিষয় নয়, সম্পর্ক রক্ষার বিষয়।


সঠিকভাবে মোকাবিলা করা সংঘাত মানুষকে শেখায়—

⇨ নিজের সীমা ও চাহিদা।

⇨ অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি।

⇨ সম্পর্কের দুর্বল জায়গা।

এই শেখাগুলো ভবিষ্যতে আরও পরিণত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।

সংঘাত কখনো পুরোপুরি দূর করা যাবে না। কারণ মানুষ আলাদা, মত আলাদা। কিন্তু সংঘাতকে ধ্বংসের পথে না ঠেলে সমাধানের পথে নেওয়াই হলো সংঘাত ব্যবস্থাপনার সার্থকতা। সঠিক কৌশল, সচেতন যোগাযোগ এবং পারস্পরিক সম্মানের সমন্বয়েই সংঘাত রূপ নিতে পারে বোঝাপড়ার সুযোগে। আর সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলেই  তা হয়ে ওঠে সম্পর্ক ও ব্যক্তিগত বিকাশের এক নতুন দরজা।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ