বৃষ্টি নেই বছরের পর বছর, তবু ফুলে ভরে যায় আতাকামা মরুভূমি! এই বিস্ময়ের রহস্য জানেন কী?

বৃষ্টি নেই বছরের পর বছর, তবু ফুলে ভরে যায় আতাকামা মরুভূমি! এই বিস্ময়ের রহস্য জানেন কী?
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

মরুভূমি মানেই চোখের সামনে ভেসে উঠে মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধু শুষ্ক পরিবেশ। মরূদ্যানে কিছু সবুজের দেখা পাওয়া যায় ঠিকই, তবে গোটা মরুভূমি ফুলে ঢেকে যাওয়ার ঘটনা সত্যিই খুব বিরল!

মরুভূমির শুষ্কতার মধ্যেও এক অন্য ধরনের আকর্ষণ রয়েছে। রুক্ষ প্রান্তরকে কাছ থেকে দেখার ইচ্ছাতেই মানুষ ওই রুক্ষ ভূমিতে ছুটে যান। এমনই এক মরুভূমিতে শুষ্কতার বদলে লেগেছে প্রাণের ছোঁয়া। যে প্রান্তর এতদিন ছিল রুক্ষ ও প্রাণহীন সেটাই এখন রং বেরংয়ের ফুলে ভরে গিয়েছে। সাদা এবং বেগুনি ফুলের মেলা বসেছে সেখানে। মরুভূমির উপর কেউ যেন রঙিন চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। এমন অসামান্য দৃশ্য দেখা গেছে চিলির আতাকামা মরুভূমিতে। এই আতাকামা পৃথিবীর সবচেয়ে শুষ্ক স্থান গুলির মধ্যে একটি। যেখানে একফোঁটা পানির আশা করা যেখানে বোকামি, সেখানে এত ফুলের সমাহারে অবাক হতেই হয়। এটি এমন এক ভূখণ্ড, যেখানে বছরের পর বছর আকাশ থেকে এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ে না। রুক্ষ বালুর বুক চিরে ফুটে ওঠে হাজার হাজার রঙিন ফুল। এই ঘটনা শুধু চোখ ধাঁধানো নয়, এটি প্রকৃতির এক গভীর বার্তা। প্রশ্ন জাগে, বৃষ্টি না থাকলে ফুল আসে কোথা থেকে? কীভাবে বেঁচে থাকে এই গাছগুলো?

দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম প্রান্তে বিস্তৃত আতাকামা মরুভূমি প্রায় ১,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। প্রশান্ত মহাসাগর এক পাশে, অ্যান্ডিজ পর্বতমালা অন্য পাশেসএই ভৌগোলিক অবস্থানই একে করেছে চরম শুষ্ক। এখানে এমন এলাকাও আছে, যেখানে দশকজুড়ে কোনো বৃষ্টিপাতের রেকর্ড নেই। বাতাসে আর্দ্রতা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। দিনের বেলা প্রচণ্ড তাপ, রাতে হিমশীতল ঠান্ডা। সাধারণ হিসাবে দেখলে, এখানে কোনো উদ্ভিদের টিকে থাকার কথা নয়। 

আতাকামার এই বিস্ময়কর ঘটনাকে বলা হয় ডেসিয়ের্তো ফ্লোরিদো, অর্থাৎ ফুলে ভরা মরুভূমি। এটি কোনো বার্ষিক নিয়মিত ঘটনা নয়। অনেক সময় ৫–৭ বছরেও একবার ঘটে। যখন ঘটে, তখন কয়েক সপ্তাহের জন্য মরুভূমির রং বদলে যায়, হয়ে উঠে বেগুনি, গোলাপি, হলুদ, সাদা ফুলে ঢেকে যায় এক সময়ের নিষ্প্রাণ ভূমি। কিন্তু এই ফুল ফোটার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ প্রস্তুতি ও সূক্ষ্ম প্রাকৃতিক কৌশল।

আতাকামায় বৃষ্টি না হলেও পানি পুরোপুরি অনুপস্থিত নয়। এখানে পানি আসে তিনটি ভিন্ন উৎস থেকে-
১. কুয়াশা থেকে আর্দ্রতা: প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভেসে আসা ঠান্ডা বাতাস পাহাড়ে আটকে ঘন কুয়াশা তৈরি করে। এই কুয়াশা থেকেই সামান্য আর্দ্রতা মাটিতে জমা হয়।\

২. বিরল কিন্তু কার্যকর হালকা বৃষ্টি: কখনো কখনো অস্বাভাবিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হালকা বৃষ্টি হয়, যা হয়তো কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী, কিন্তু সেটাই যথেষ্ট।

৩. ভূগর্ভস্থ লুকানো পানি: কিছু এলাকায় বহু শতাব্দী আগে জমে থাকা আর্দ্রতা এখনো মাটির গভীরে রয়ে গেছে। এই অল্প জলই মরুভূমির সবচেয়ে বড় সম্পদ।

আতাকামার ফুলগুলো হঠাৎ জন্মায় না। এগুলোর বীজ বছরের পর বছর, কখনো কখনো দশকের পর দশক, মাটির নিচে নিস্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে থাকে। এই বীজগুলো পানির অনুপস্থিতিতে সক্রিয় হয় না এবং প্রচণ্ড তাপ ও লবণাক্ত মাটিতে নষ্টও হয় না। উপযুক্ত সংকেত না পাওয়া পর্যন্ত ‘ঘুমিয়ে’ থাকে।যখন সামান্য পানি মাটিতে পৌঁছায়, তখনই শুরু হয় বিস্ময়।

আতাকামার উদ্ভিদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো অত্যন্ত দ্রুত জীবনচক্র।পানি পাওয়ার পর কয়েক দিনের মধ্যেই বীজ অঙ্কুরিত হয় ও খুব অল্প সময়ের মধ্যে গাছ বড় হয়। দ্রুত ফুল ফোটে এবং বীজ তৈরি করে। কারণ তারা জানে, এই সুযোগ ক্ষণস্থায়ী। পানি শুকিয়ে যাওয়ার আগেই পরবর্তী প্রজন্মের বীজ তৈরি না করলে সব শেষ।
আতাকামার ফুলগুলো শুধু সুন্দর নয়, অত্যন্ত কৌশলী। উজ্জ্বল রং দূর থেকে পোকামাকড়কে আকর্ষণ করে। তীব্র কিন্তু স্বল্পস্থায়ী গন্ধ দ্রুত পরাগায়ন নিশ্চিত করে। ফুলের গঠন এমনভাবে তৈরি, যাতে অল্প সময়েই কাজ শেষ হয়। এখানে পরাগবাহী প্রাণীও কম, তাই প্রতিটি সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার জরুরি।

ফুল ফোটার সঙ্গে সঙ্গে মরুভূমিতে ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গ, পাখি, কখনো ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা যায়, যারা দীর্ঘ সময় অনুপস্থিত ছিল, তারাও যেন এই সংকেত পেয়ে ফিরে আসে। কয়েক সপ্তাহের জন্য আতাকামা পরিণত হয় এক সম্পূর্ণ সক্রিয় বাস্তুতন্ত্রে।

বিশ্বজুড়ে খরা বাড়ছে, বৃষ্টির ধরন বদলাচ্ছে। অনেক অঞ্চল ধীরে ধীরে আতাকামার মতো শুষ্ক হয়ে উঠছে। এই মরুভূমির ফুল শিক্ষা দেয় -প্রতিকূলতা মানেই শেষ নয়। টিকে থাকার কৌশল সময়ের সঙ্গে বদলায়।

সতর্কতা:
ফুল ফোটার সময় আতাকামায় পর্যটনের ঢল নামে। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন,
অতিরিক্ত মানুষের চলাচলে এই সূক্ষ্ম উদ্ভিদ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

কারণ-
⇨ একবার পায়ের চাপে বীজ নষ্ট হলে।
⇨ পরবর্তী কয়েক বছর সেই এলাকায় আর ফুল নাও ফুটতে পারে।
⇨ এই বিস্ময় রক্ষা করাও মানুষের দায়িত্ব।

চিলির আতাকামা মরুভূমি প্রমাণ করে, জীবন কখনো শুধু অনুকূল পরিবেশের ওপর নির্ভর করে না। জীবন নির্ভর করে অপেক্ষা, ধৈর্য আর সঠিক সময়ের ওপর, যেখানে আমরা দেখি শূন্যতা, সেখানে প্রকৃতি দেখে সম্ভাবনা। যেখানে আমরা ভাবি সব শেষ, সেখানে মাটির নিচে জমে থাকে আগামী দিনের রঙ।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ