অনিদ্রা, স্লিপ অ্যাপনিয়া, স্ট্রেস? স্লিপ মনিটর দিচ্ছে আগাম সংকেত!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
-
আমাদের জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় শুধু ঘুমেই কাটে। ঘুম মানে কিন্তু শুধু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকা না। এটা শরীর ও মনকে পুনরুজ্জীবিত করার একটি জটিল, নিয়ন্ত্রিত, এবং বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া।আধুনিক জীবনের চাপ, অনিয়মিত জীবনযাপন, স্ক্রিনের আলো, মানসিক উদ্বেগ সব মিলিয়ে ঘুমের গুণমান অনেকেই হারিয়ে ফেলছেন। আর ঠিক এই জায়গাতেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ওয়্যারেবল স্লিপ মনিটর। এটি এক ধরনের পরিধেয় প্রযুক্তি, যা আমাদের ঘুমের রিয়েল-টাইম তথ্য সংগ্রহ করে, বিশ্লেষণ করে এবং বলে দেয় ঘুম কেমন হচ্ছে ও কেন।
ঘুম বা নিদ্রা মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের ফাঁকে বিশ্রাম নেওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ঘুমের সময় যখন সচেতন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া স্তিমিত থাকে। ঘুম মাত্রা ও পর্যায়ে বিভক্ত। সাধারণত ঘুমকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়-
প্রথম দুই ধাপ হালকা ঘুম, পরের ধাপ গভীর ঘুম ও সর্বশেষ ধাপ র্যাপিট আই মোশন (REM) বা স্বপ্ন দেখা ঘুম। প্রতিটি পর্যায়ে শরীর ও মস্তিষ্কের কাজ আলাদা- হৃৎপিণ্ডের গতি কমে যায়, মস্তিষ্ক তথ্য সাজায়, শরীর কোষ ও টিস্যুর পুনর্গঠন শুরু করে, স্মৃতি সংরক্ষণ হয় ইত্যাদি।
ওয়্যারেবল স্লিপ মনিটরকে ঘড়ির মতো দেখালেও এটি শুধুই ঘড়ি নয়। এটি একটি বায়োমেট্রিক সেন্সর ভিত্তিক ডিভাইস যা শারীরিক তথ্য সংগ্রহ করে এবং সেই তথ্য থেকে ঘুমের ধাপ বুঝে। ঘুমের সময় আমাদের শরীরে কী কী হচ্ছে তা বুঝতে এই ডিভাইস একসাথে নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে।যেমন- হার্ট রেট সেন্সর দেখে নেয় রাতভর আপনার হৃদস্পন্দন স্থির ছিল নাকি দ্রুত হয়েছে,নাকি আবার ধীর হয়েছে। মুভমেন্ট সেন্সর বা অ্যাক্সিলোমিটার বুঝে নেয় আপনি ঘুমের সময় কতটা নড়াচড়া করছেন, যা ঘুমের কোন পর্যায়ে আছেন তা বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। স্কিন টেম্পারেচার সেন্সর আপনার ত্বকের তাপমাত্রা কীভাবে ওঠানামা করছে তা পর্যবেক্ষণ করে, কারণ তাপমাত্রার পরিবর্তনের সাথে ঘুমের গভীরতার সম্পর্ক থাকে। পাশাপাশি SpO₂ সেন্সর দেখে আপনার নিঃশ্বাসে অক্সিজেন কতটা ঠিকভাবে চলাচল করছে। এই সব তথ্য একসঙ্গে বিশ্লেষণ করে ডিভাইসটি জানায় একজন ব্যক্তি মোট কতক্ষণ ঘুমিয়েছেন, ঘুম কতটা গভীর ছিল, ঘুম ভাঙার পর আবার কত দ্রুত ঘুমে ফিরেছেন, এমনকি রাতে কতবার ঘুম ভেঙেছে বা ব্যাঘাত ঘটেছে।
ধরা যাক, আপনি আপনার বাহুর কব্জিতে একটি মনিটর পরেছেন। রাত যখন আসে, ডিভাইসটি আপনার রক্তের তাপমাত্রা, হৃদয়ের গতি, শরীরের নড়াচড়া ইত্যাদি সবকিছু ধারাবাহিকভাবে রেকর্ড করে। এই তথ্যগুলো অ্যালগোরিদমের মাধ্যমে সাজানো হয়। যেমন, যদি হৃদস্পন্দন ধীরে ধীরে কমে, শরীর কম নড়াচড়া করে, তাহলে তা সাধারন ঘুমের ধাপ। যদি ঘন ঘন শরীর নড়াচড়া হয়, তাহলে ঘুম কম গভীর বা বিছিন্ন ঘুম। REM phase-এ চোখের নড়াচড়া বেশি কিন্তু শরীর স্থির থাকে, এটি ডিভাইস শনাক্ত করতে পারে। এই মিলিত তথ্য ব্যস্ত অ্যালগোরিদম বিশ্লেষণ করে ঘুমের সম্পূর্ণ চিত্রের রিপোর্ট দেয় ।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কোনও প্রযুক্তি তখনই কার্যকর, যখন তা তথ্য ভিত্তিক, পুনরায় যাচাইযোগ্য এবং নির্ভুল। ওয়্যারেবল স্লিপ মনিটরগুলো একটি বড় সুবিধা দেয় তা হলো, এগুলো নিরবিচ্ছিন্ন, বাস্তব-সময়ের তথ্য সংগ্রহে সক্ষম। ক্লিনিকাল ঘুম-স্টাডি যাকে পলিসোমনোগ্রাফিও বলা হয়,তা যতটাই সঠিক, ওয়্যারেবল ডিভাইসের তুলনা কিছুক্ষেত্রে সে রকম নাও হতে পারে। তবে, দৈনন্দিন পর্যবেক্ষণে এগুলো অত্যন্ত কার্যকর।কারণ, এগুলো মানুষের ঘুমের দৈনন্দিন প্যাটার্নকে দীর্ঘ সময়ের জন্য পর্যবেক্ষণ করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ব্যবহার করলে ঘুমের অভ্যাস, ঘুম ভাঙার কারণ ও ঘুমের গুণমান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা পাওয়া যায়।
যাদের জন্য ডিভাইসিট সবচেয়ে উপযোগী?
১. যারা ঘুম নিয়ে চিন্তিত- অনেকেই ঘুমের সময় প্রাণঘাতী রোগের আশঙ্কা করেন। যেমন- হয়তো ঘুমে নিশ্বাস বন্ধ হওয়া, ঘন ঘন জাগা, স্বপ্ন দেখে ভরসা না পাওয়া অবস্থা ইত্যাদি। এই মনিটর ঘুমের প্যাটার্ন দেখে প্রাথমিক পর্যায়ে বোঝাতে সাহায্য করে কি আপনার ঘুম স্বাভাবিক, না কোনো ভিত্তিগত সমস্যার ইঙ্গিত।
২. কর্মব্যস্ত যারা- স্ক্রিন-সম্পর্কিত জীবনযাত্রা, রাতে দেরিতে ঘুম, সকালে জাগার ফলে ঘুম সবসময় পর্যাপ্ত হয় না। ডিভাইসটি দেখে দেয় কতটা প্রকৃত ঘুম পাচ্ছেন, আর কী পরিবর্তন করলে ঘুম ভালো হবে।
৩. খেলাধুলা ও স্বাস্থ্য সচেতন লোকজন* অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম স্বাস্থ্যকর। ঘুমের পর্যায়ের তথ্য মিলিয়ে আপনার শরীর পুনরায় পুরোপুরি রিকভার হচ্ছে কি না তা ডিভাইসটি বলে দেয়।
সুবিধা:
১. তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া! আগে মানুষ শুধু অনুমান করত আর এখন হাতের স্ক্রীনে দেখতে পারে যে রাতে কতবার ঘুম ভাঙছে, গভীর ঘুম কতক্ষণ, নিশ্বাস প্রবাহ কেমন ইত্যাদি। এই তথ্য ঘুমের আসল সমস্যাটা খুঁজে বের করতে সাহায্য করে।
২. প্রতিদিনের ঘুম-রুটিনে পরিবর্তন আনতে উৎসাহ দেওয়া। অনেক সময় আমরা খুঁটিনাটি ভুল করি,যেমন - বিছানায় ফোন নিয়ে সময় কাটাই, রাতে কফি বেশি খাই, ঘণ্টার পর ঘণ্টা নেটফ্লিক্স দেখি!ডিভাইসের রিপোর্ট দেখে সেই ভুলগুলো সহজেই শনাক্ত করা যায়।
৩. দীর্ঘমেয়াদি ট্রেন্ড বিশ্লেষণ করা! একদিন নয়, সপ্তাহ, মাস, এমনকি বছর ধরে ঘুমের তথ্য থাকলে আপনি নিজের ঘুমের প্যাটার্ন বুঝতে পারবেন।কোথায় সমস্যা শুরু হচ্ছে, কীভাবে মানসিক চাপ বা খাদ্যাভ্যাস ঘুমকে প্রভাবিত করছে, সবই দেখে নিতে পারবেন।
সীমাবদ্ধতা:
প্রতিটি প্রযুক্তির মতো এখানে কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে-
⇨ চিকিৎসাগত নির্ণয়ের বিকল্প নয়: ডিভাইসটি আপনাকে জানান দেবে তথ্য। যেমন- ঘুম ভাঙছে বেশি, অক্সিজেন কম যাচ্ছে ইত্যাদি। কিন্তু রোগ নির্ণয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে চিকিৎসকের পেশাগত পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ অপরিহার্য।
⇨ ব্যক্তিগত পার্থক্য: প্রত্যেক মানুষের শরীর ও ঘুমের গঠন আলাদা। সব ডেটা এক-সাথে মিলিয়ে ব্যাখ্যা করা সবসময় সহজ নয়।
⇨ সঠিক পরিণতি পেতে ধারাবাহিক ব্যবহার জরুরি: এক-দুই রাত না, বরং নিয়মিত ব্যবহারেই ঘুমের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায়।
ভালো ঘুম মানে শুধু বিশ্রাম নয়। এটি-
◑ স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধি করে
◑ মানসিক চাপ কমায়
◑ হার্টের স্বাস্থ্য উন্নত করে
◑ ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে
ওয়্যারেবল স্লিপ মনিটর এই সম্পর্ককে পরিসংখ্যান, বিশ্লেষণ ও তথ্য দিয়ে পরিষ্কার করে দেয়, যা আগে ছিল অনুমান, এখন সেটা পরিমাপযোগ্য সত্যে রূপান্তরিত।
ওয়্যারেবল স্লিপ মনিটর কোনো জাদুকরি গ্যাজেট নয় যা বারোটা বাজালেই রাতে ঘুমিয়ে রাখবে। কিন্তু এটি যা করতে পারে তা হলো আপনার ভেতরের তথ্যকে প্রকট করে তোলবে। ঘুম সম্পর্কে আমাদের ধারণা যেটা ছিল এবার সেটা বাস্তব তথ্যের আলোকে দেখা যাবে। আর সেই তথ্যের ভিত্তিতে জীবনের রুটিন, খাদ্যাভ্যাস, মন মিলিয়ে একটি স্বাস্থ্যকর ঘুমের পথে এগিয়ে যাওয়া সহজতর হবে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।