চীনের পরিকল্পনায় ভারতের আশঙ্কা: নতুন বছরে নতুন চ্যালেঞ্জ

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
দুই বাংলায় যাকে প্রায়ই ‘মহাচীন’ বলা হয়, সেই চীনকে নিয়ে ভারতের উদ্বেগের যেন শেষ নেই। সম্পর্কের উন্নতি হলেও নতুন করে উদ্বেগের জন্ম হয় বারবার। নতুন বছরে সেই চিত্র আবারও স্পষ্ট হয়েছে। অরুণাচল প্রদেশের মন্ত্রীদের সাম্প্রতিক বক্তব্য এবং ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়ায় এই উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে।
অরুণাচল প্রদেশের উত্তরে অবস্থিত আপার সিয়াং জেলা। এর ঠিক ওপরে তিব্বতের দক্ষিণে মেডগ কাউন্টিতে চীন বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করছে। ইয়ারলুং সাংপো নদীর ওপর নির্মিত এই বাঁধের মূল্য ১৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটি শুধু বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্পই নয়, সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। গত ২৫ ডিসেম্বর প্রকল্প নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে চীন জানিয়েছে, ভাটির দেশগুলোর সঙ্গে পানিপ্রবাহ নিয়ে আলোচনা করবে তারা।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং বলেছেন, ‘যোগাযোগের বিদ্যমান ব্যবস্থার মাধ্যমে চীন ভাটির দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে এবং নদীর তীরে জনগণের সুবিধার জন্য দুর্যোগ প্রতিরোধ ও ত্রাণসহায়তা বাড়াবে।’ ভাটির দেশ বলতে মূলত ভারত ও বাংলাদেশকে বোঝানো হয়েছে। নিং আরও বলেছেন, এই প্রকল্প ভাটির দেশগুলোকে প্রভাবিত করবে না।
২০২০ সালে ভারত ও চীনের সীমান্তে সংঘর্ষে বেশ কিছু সেনার মৃত্যু হলেও দুই দেশের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত ছিল। এর ফলে ২০২৪ সালে দুই দেশের সম্পর্কে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। গত বছর ভারত চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ১১৮ বিলিয়ন ডলার অর্জন করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলেছে। গত বছরের শেষ দিকে দুই দেশ জানিয়েছে, সীমান্ত বিরোধ মেটাতে তারা ঐকমত্যে পৌঁছেছে। তবে চীনের এই বিশাল প্রকল্প ভারতকে নতুন করে উদ্বিগ্ন করেছে।
৩ জানুয়ারি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেছেন, এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প সম্পর্কে ভারত অবগত। তিনি বলেন, ‘ভাটির দেশ হিসেবে নদীর জলের ওপর আমাদের অধিকার রয়েছে। চীনের কাছে আমরা ধারাবাহিকভাবে আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছি এবং উজানে ব্রহ্মপুত্রের ভাটির রাজ্যগুলো যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করতে আহ্বান জানিয়েছি।’
কেন ভারত উদ্বিগ্ন?
চীন ও ভারতের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ঐকমত্য থাকলেও চীন প্রতিবেশী দেশগুলোতে সরাসরি ভারতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। মনোহর পারিক্কার ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিসের সিনিয়র ফেলো উত্তম সিনহা বলেন, ‘ভারত মধ্যবর্তী নদীর দেশ। চীনের সঙ্গে ভারতের কোনো আনুষ্ঠানিক পানিবণ্টন চুক্তি নেই, যা ভারতের জন্য বড় সমস্যা।’
উত্তম সিনহা আরও বলেন, চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ইয়ারলুং নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। চীনের সর্বশেষ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নদী থেকে উদ্ভূত অর্থনৈতিক ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
ভারতের করণীয়
উত্তম সিনহা মনে করেন, ভারতের প্রথমে ‘চায়না-ফোবিয়া’ থেকে বেরোতে হবে। তিনি বলেন, ভারতের উচিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তার সামর্থ্য বাড়ানো এবং চীনের নদীগুলোর প্রবাহ পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা বাড়ানো। এছাড়া, জল ধরে রাখার অবকাঠামো ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিকল্পনা করা জরুরি।
কূটনৈতিক ফ্রন্টে চীনের সঙ্গে পানির বিষয়ে আলোচনা বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন সিনহা। তিনি বলেন, চীনের বাঁধ নির্মাণের স্থল পরিদর্শনের জন্য ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের অনুমতি দেওয়া উচিত। এছাড়া, বাংলাদেশের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র নিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করা এবং ভুটান ও বাংলাদেশের সঙ্গে বহু অববাহিকাকেন্দ্রিক চুক্তি বিবেচনা করা যেতে পারে।
অরুণাচলের পরিস্থিতি
ইয়ারলুং নদী ভারতে প্রবেশ করেছে অরুণাচল প্রদেশের সিয়াং নদী দিয়ে। অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু ও উপমুখ্যমন্ত্রী চাওনা মেয়েন বলেছেন, চীনের ৬০ হাজার মেগাওয়াটের প্রকল্প ঠেকাতে অরুণাচলে ১২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করা প্রয়োজন। তবে এই প্রকল্প নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক বিরোধ দেখা দিয়েছে।
অরুণাচলের প্রধান সংবাদপত্র অরুণাচল টাইমস সামাজিক মাধ্যমে কয়েকটি ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে স্থানীয়রা মুখ্যমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকায় আঘাত করছেন। স্থানীয়রা মনে করছেন, সরকার সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করে প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে।
অরুণাচলের প্রধান জাতিগোষ্ঠী তানির অধীনে নিশি, আদি, গালো, তাগিন ও আপাতানি সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন। পরিবেশবিদ ও মানবাধিকারকর্মী ইবো মিলি বলেন, ‘বাঁধ নির্মাণ অরুণাচলে ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। গোটা মন্ত্রিসভা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণকারী সংস্থার মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে।’
মিলির মতে, চীনের বাঁধের ফলে অরুণাচল বিপদে পড়বে এমন ধারণা ভিত্তিহীন। তিনি বলেন, সিয়াংয়ের জলের মাত্র ৩০ শতাংশ ইয়ারলুং থেকে আসে, বাকি ৭০ শতাংশ ভারতের হিমবাহ থেকে আসে। এছাড়া, চীনের ভেতরেই অসংখ্য গ্রাম রয়েছে, যা জল প্রবাহের আগেই ভাসিয়ে দেবে।
অরুণাচল সরকারের অবস্থান
অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু ও উপমুখ্যমন্ত্রী চাওনা মেয়েন বাঁধ নির্মাণের পক্ষে একাধিক যুক্তি দিয়েছেন। তারা বলেছেন, চীনের প্রকল্পের প্রভাব শুধু অরুণাচলে সীমাবদ্ধ থাকবে না, পশ্চিমবঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে স্থানীয়দের সম্মতি ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে না বলেও জানিয়েছেন তারা।
শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী খান্ডু বলেছেন, ‘মানুষ না চাইলে সিয়াং প্রকল্প হবে না।’ তবে তিনি এও বলেছেন যে সমাজকর্মীরা ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন।
এদিকে, ইউনাইটেড তানি আর্মি (ইউটিএ) নামে একটি সংগঠনের আবির্ভাব নিয়ে অরুণাচল পুলিশ উদ্বিগ্ন। যদিও ধারণা করা হচ্ছে, এই সংগঠনের বাঁধ নির্মাণের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। তবে অরুণাচলের মতো রাজ্যে, যেখানে সশস্ত্র আন্দোলনের ইতিহাস নেই, সেখানে এই ধরনের সংগঠনের আবির্ভাব প্রশাসনকে চিন্তিত করেছে।
সব মিলিয়ে, চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও নতুন বছরের শুরুতে এই ইস্যু নিয়ে ভারত কিছুটা উদ্বিগ্ন।