সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হাসিনা সরকার ব্রিটিশ আইনজীবীর সহায়তা চেয়েছিল

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
আল–জাজিরার ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ নামের আলোচিত প্রামাণ্যচিত্র সম্প্রচারের পর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা ব্যারিস্টার ডেসমন্ড ব্রাউনি কে সি-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল শেখ হাসিনার সরকার। সম্প্রতি গণভবন থেকে উদ্ধারকৃত একটি নথিতে এই তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। নথিটি শেখ হাসিনার শোবার ঘরে জীর্ণ অবস্থায় পাওয়া গেছে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে লন্ডনে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তারা ডেসমন্ড ব্রাউনির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ব্রাউনি হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজি হন এবং তাদের একজন আইনজীবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। পরবর্তী কয়েক মাস ধরে ব্রাউনি ও সেই আইনজীবী শেখ হাসিনা সরকারকে নানা পরামর্শ দেন।
এই যোগাযোগের কয়েক দিন আগেই আল–জাজিরা ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ নামের প্রামাণ্যচিত্রটি সম্প্রচার করে। প্রামাণ্যচিত্রে বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের ভাইকে বলতে শোনা যায়, তিনি বিরোধীদের অপহরণ এবং বিপুল অঙ্কের ঘুষ নেওয়ার জন্য পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করতে পারেন। প্রামাণ্যচিত্রটিতে শেখ হাসিনা সরকারের দুর্নীতির বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়েছিল। তবে বাংলাদেশ সরকার এই প্রামাণ্যচিত্রকে ‘মিথ্যা’ ও ‘রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে উল্লেখ করে।
প্রামাণ্যচিত্রটি সম্প্রচারের পর এর তথ্যদাতা জুলকারনাইন সায়ের খানের ভাইকে রড দিয়ে পিটানো হয়। এছাড়া প্রামাণ্যচিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই দেশত্যাগ করেন বা প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে দেশে ফিরতে অস্বীকার করেন।
গণভবনে পাওয়া নথি অনুযায়ী, ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তারা ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে ডেসমন্ড ব্রাউনির সঙ্গে আলোচনা করেন। ব্রাউনি ভবিষ্যতে আল–জাজিরার বিরুদ্ধে মামলা লড়তে প্রস্তুত ছিলেন বলে জানান। তবে তিনি হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের একজন আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। এরপর ব্রাউনির পরামর্শে লন্ডনের আইনি সহায়তা প্রতিষ্ঠান পেনিংটন মানচেস কুপারের বিশেষজ্ঞ জেরেমি ক্লার্ক–উইলিয়ামসের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশ সরকার।
২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বৈঠকে শেখ হাসিনার প্রতিনিধিরা ক্লার্ক–উইলিয়ামসকে বলেন, আল–জাজিরার প্রামাণ্যচিত্রে ‘সারবত্তা তেমন কিছু না থাকলেও’ এটি শেখ হাসিনার সুনাম ‘ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন’ করেছে। বাংলাদেশ সরকার বা সেনাবাহিনীর মতো কোনো প্রতিষ্ঠান বা সেনাপ্রধানের মতো কোনো ব্যক্তি এই প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে আদালতে মানহানির মামলা করবে কি না, সে বিষয়ে পরামর্শ চাওয়া হয়। এছাড়া সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা, যিনি প্রামাণ্যচিত্রে নেই কিন্তু মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর মানহানি হয়েছে, তাঁর মতো তৃতীয় পক্ষ মানহানির মামলা করবে কি না, তা নিয়েও পরামর্শ চাওয়া হয়।
নথি অনুযায়ী, শেখ হাসিনা সরকার আল–জাজিরার প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে যুক্ত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে গ্রেপ্তারের পরিকল্পনাও করেছিল। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা ক্লার্ক–উইলিয়ামসকে জানান, তাঁরা বার্গম্যানের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য প্রস্তুত। কর্মকর্তাদের মতে, বার্গম্যানই এই ‘রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের পেছনে দায়ী ছিলেন। তাঁকে বাংলাদেশে গ্রেপ্তার করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
তবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাজ্যের আদালতে মামলা না করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিবর্তে তারা ফেসবুক ও ইউটিউবকে চাপ দিয়ে প্রামাণ্যচিত্রটি সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। বাংলাদেশের হাইকোর্টের রায় সত্ত্বেও ফেসবুক ও ইউটিউব প্রামাণ্যচিত্রটি সরিয়ে নেয়নি। বর্তমানে এই প্রামাণ্যচিত্রটি এখনও ফেসবুক ও ইউটিউবে দেখা যায়।
ডেসমন্ড ব্রাউনি সম্প্রতি আইন পেশা থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনি সানডে টাইমসকে বলেন, ‘১০ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক আলোচনার পর আমি ও ক্লার্ক–উইলিয়ামস বাংলাদেশ হাইকমিশনকে পরামর্শ দিয়েছিলাম। তবে আমার জানামতে, ওই পরামর্শের পর আমরা আর কোনো পদক্ষেপ নিইনি। ২০২১ সালের মার্চ মাসে আমাদের দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী কোনো চিঠিপত্র বা মামলা করা হয়নি।’ এ বিষয়ে ক্লার্ক–উইলিয়ামসের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।