দৈনন্দিন যিকির -অন্তরের শান্তি ও জীবনের বরকতের গোপন চাবিকাঠি

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
ব্যস্ত এই যান্ত্রিক জীবনে মানুষ দিন দিন হারিয়ে ফেলছে মানসিক প্রশান্তি। স্ট্রেস, দুশ্চিন্তা আর একাকিত্বে ক্লান্ত হৃদয়কে শান্ত করতে, হাজারো মানুষ আজ ফিরে যাচ্ছে যিকিরের শান্ত নদীতে। আরবি 'যিকর' শব্দের অর্থ স্মরণ করা—আল্লাহ্র স্মরণ। এই যিকিরই হয়ে উঠছে আজ বহু মুসলিমের জীবনের রাহাত ও আত্মার সঞ্জীবনী শক্তি।
যিকির মানেই কেবল তসবিহ নয় – এটি এক জীবন্ত সংযোগ। দৈনন্দিন যিকির শুধু মুখে উচ্চারণ নয়, এটি এক অন্তরের আহ্বান।
বিশেষজ্ঞ আলেমরা বলেন, "যিকির এমন এক ইবাদত, যা প্রতিদিনের ব্যস্ততম রুটিনেও সহজে করা যায় – হাঁটতে হাঁটতে, গাড়িতে বসে, এমনকি অফিসের ডেস্কেও।"
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা পবিত্র কুরআনে বলেন,
"নিশ্চয়ই আল্লাহর যিকিরে অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়।"
— সূরা রা'দ, আয়াত ২৮
দৈনন্দিন কিছু গুরুত্বপূর্ণ যিকিরসমুহ -
জিকির -১ : 'সুবহান আল্লাহ্'
প্রতিদিন ১০০ বার পাঠ করলে ১০০০ সাওয়াব লিখা হয় এবং ১০০০ গুনাহ মাফ করা হয়।
[সহীহ মুসলিম-৪/২০৭৩]
জিকির -২ : 'আলহামদুলিল্লাহ'
মীযানের পাল্লাকে ভারী করে দেয় এবং সর্বোত্তম দোআ'।
[তিরমিযী-৫/৪৬২,ইবনে মাযাহ-২/১২৪৯,হাকিম-১/৫০৩,সহীহ আল জামে'-১/৩৬২]
জিকির -৩ : 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' সর্বোত্তম যিকর। [তিরমিযী]
জিকির -৪ : সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী'
যে ব্যক্তি ' প্রতিদিন ১০০ বার পাঠ করবে সমুদ্রের ফেনা পরিমান (সগীরা) গুনাহ থাকলে ও তাকে মাফ করে দেওয়া হবে।
[সহীহুল বুখারী : ৬৪০৫; সহীহ মুসলিম : ৭০১৮।]
জিকির -৫ : সুবহানাল্লাহি ওয়াবি হামদিহী সুবহানাল্লিল আযীম'
নবী (সঃ) বলেনঃ 'এই কালীমাগুলি জিহ্বায় উচ্চারনে সহজ , মীযানের পাল্লায় ভারী ,দয়াময় আল্লাহর নিকট প্রিয় ।
[সহিহ বুখারী ,হাদিস নাম্বারঃ ৭০৫৩]
জিকির -৬ : 'সুবহানাল্লাহিল আযীমি ওয়াবি হামদিহী'
যে ব্যক্তি পাঠ করবে প্রতিবারে তার জন্য জান্নাতে একটি করে (জান্নাতী) খেজুর গাছ রোপন করা হবে ।
[(তিরমিযী হা/৩৪৬৪; মিশকাত হা/২৩০৪; ছহীহাহ হা/৬৪)]
জিকির -৭ : 'লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ'
নবী (সঃ) বলেনঃ হচ্ছে জান্নাতের গুপ্তধন সমুহের মধ্যে একটি গুপ্তধন।
[সহীহুল বুখারী ৪২০৫, মুসলিম ২৭০৪, তিরমিযী ৩৩৭৪, ২৪৬১, আবূ দাউদ ১৫২৬, আহমাদ ১৯০২৬, ১৯১০২, ১৯১৫১, ১৯২৪৬, ১৯২৫৬, রাওদুন নাদীর ১০৪১। তাহকীক আলবানীঃ সহীহ।]
জিকির - ৮ : "বিসমিল্লাহি তাওয়াক'কালতু আলাল্লাহি ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কু'ওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। "
রাসূল বলেছেন যে ব্যাক্তি এই দোয়া পড়ে ঘর থেকে বেরোবে সকল বিপদ থেকে সে নিরাপদে থাকবে ও ইবলিশ শয়তান তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। (তিরমিজী শরীফ, খন্ড-২ পৃষ্ঠা-১৮০)
জিকির - ৯ : উপরে ওঠার সময় 'আল্লাহু আকবার' জিকির করা।
জিকির - ১০ : নিচে নামার সময় 'সুবহানাল্লাহ' জিকির।
জিকির - ১১ : সমতলে হাটার সময় 'লা ইলাহা ইল্লাহ' জিকির।
গবেষণায় যা উঠে এসেছে :
একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত যিকির করলে—
১। মানসিক চাপ কমে যায়
২। সেলফ-কন্ট্রোল ও ধৈর্য বাড়ে
৩। ঘুমের মান উন্নত হয়
৪। এমনকি হৃদস্পন্দনের ভারসাম্য বজায় থাকে
বিশ্বখ্যাত "American Journal of Islamic Psychology"-তে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়, যিকির একটি প্রাকৃতিক মাইন্ডফুলনেস টেকনিক – যা মেডিটেশন থেকেও অধিক কার্যকর হতে পারে। যিকির কেবল ইবাদত নয়, এটি একটি লাইফস্টাইল আজকাল অনেক মুসলিম তরুণ-তরুণী নিজস্ব যিকির রুটিন তৈরি করছেন, কেউ ফোনে রিমাইন্ডার দিয়ে, কেউ ডায়েরিতে লিখে রাখছেন প্রিয় দোয়া আর স্মরণ। এমনকি প্রযুক্তির যুগে "Digital Tasbeeh", যিকির অ্যাপ, এবং ইসলামিক ওয়াচ ফেস এখন তাদের জীবনের অংশ। আলহামদুলিল্লাহ।
সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের চাবিকাঠি :
বাংলাদেশের অনেক মাদ্রাসা, স্কুল এবং অফিসে "সকাল বেলায় এক মিনিট যিকির" কর্মসূচি চালু হয়েছে। এতে করে শিক্ষার্থী ও কর্মীদের মধ্যে একধরনের মানসিক ভারসাম্য ও সহনশীলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বিশেষ বার্তা :
দৈনন্দিন যিকির শুধু আমাদের জীবনের অংশ নয়, এটি আমাদের আত্মার খাদ্য। যখন আমরা যিকির করি, তখন আমরা কেবল শব্দ উচ্চারণ করি না—আমরা একটি উচ্চতর সংযোগের দিকে ফিরে যাই। সেই সংযোগ, যা আমাদেরকে পৃথিবীর তুচ্ছ চিন্তা থেকে সরিয়ে এনে এক অনন্ত প্রশান্তির জগতে পৌঁছে দেয়।
আসুন, আমরা সবাই আমাদের জীবনের প্রতিদিনের রুটিনে অন্তত ১৫ মিনিট যিকির রাখি। শুধু সওয়াবের জন্য নয়, আত্মার আরাম এবং মনকে শুদ্ধ রাখার জন্য। ইন শা আল্লাহ।