কনফার্মেশন বায়াস, কেন আমরা শুধু নিজের মতের পক্ষেই প্রমাণ খুঁজি?

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
আমরা সবাই কমবেশি এমন পরিস্থিতিতে পড়েছি, যেখানে কারও সঙ্গে যুক্তিতর্কে জড়ানোর পরও নিজের অবস্থান থেকে সরে আসতে চাইনি। বরং নিজের মতকে জোরালোভাবে প্রমাণ করার জন্য আরও "প্রমাণ" খুঁজে বেড়িয়েছি – এমনকি সেগুলো অর্ধসত্য হলেও। মনোবিজ্ঞান এই আচরণকে বলে "কনফার্মেশন বায়াস" (Confirmation Bias)।
এই মানসিক প্রবণতা মানে হলো, মানুষ এমন তথ্য খোঁজে, বিশ্বাস করে এবং মনে রাখে, যা তার পূর্বনির্ধারিত বিশ্বাস বা মতের সঙ্গে মেলে। বিরোধী প্রমাণ বা তথ্য থাকলেও, তা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাই বেশি দেখা যায়।
✪ কিভাবে কাজ করে কনফার্মেশন বায়াস?
মানব মস্তিষ্কের একটি আকর্ষণীয় দিক হলো – এটি তথ্যে একটি অস্বাভাবিক ধরনের নির্বাচন তৈরি করে। যখন আমরা কোনো বিষয় সম্পর্কে বিশ্বাস স্থাপন করি, তখন আমাদের মস্তিষ্ক এমন তথ্যকে আরও গুরুত্ব দেয় যা সেই বিশ্বাসকে সমর্থন করে। ধরুন, আপনি যদি বিশ্বাস করেন যে একটি নির্দিষ্ট খাবার আপনার স্বাস্থ্য ভাল রাখবে, তবে আপনি খাবারের পক্ষে সমস্ত প্রমাণ খুঁজে বের করবেন, এবং এর বিরোধী যেকোনো প্রমাণকে আপনি অবজ্ঞা করতে থাকবেন।
এই বায়াস আমাদের চিন্তার প্রক্রিয়ায় গভীরভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। এর একটি উদাহরণ হলো জনপ্রিয় সামাজিক মিডিয়ায় যে ধরনের কনটেন্ট আমরা দেখি। ফেসবুক, টুইটার বা ইউটিউবের অ্যালগরিদমগুলো আমাদের আগের পছন্দের ভিত্তিতে একই ধরনের কনটেন্ট আরেকবার আমাদের সামনে নিয়ে আসে। যার ফলে আমরা একপাক্ষিকভাবে তথ্য গ্রহণ করতে থাকি, এবং যেকোনো বিরোধী মতকে উপেক্ষা করি।
✪ বিজ্ঞান কী বলছে?
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির একটি বিখ্যাত গবেষণায় দেখা গেছে, দুই গ্রুপের মানুষকে একই তথ্য দেওয়া হলেও, তারা তথ্যটি নিজেদের মতের পক্ষে ব্যবহার করেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি মানুষের "কগনিটিভ বায়াস" বা চিন্তার বিকৃতি – যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং মত গঠনে প্রভাব ফেলে।
নিউরোসায়েন্স গবেষণাও বলছে, মস্তিষ্ক নতুন তথ্য গ্রহণের সময় আগে থেকেই গঠিত মতামতের সঙ্গে সেটি কতটা মিলছে, তা বিবেচনা করে। ফলে মস্তিষ্ক সেই তথ্যকে 'নির্বাচিত' করে নেয়, যা নিজের মতকে সমর্থন করে।
✪ বাস্তব জীবনে এর প্রভাব :
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা ক্ষেত্রে কনফার্মেশন বায়াস দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। আসুন কয়েকটি উদাহরণ দেখে নেই:
⇨ রাজনীতি: একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থক যদি তার দলের বিষয়ে কোনও নেতিবাচক খবর শোনে, তবে তিনি সেই খবরের সত্যতা যাচাই করতে পারেন না, বরং তিনি তার দলকে সঠিক এবং অন্য দলকে ভুল বলার জন্য নানা প্রমাণ খুঁজে বের করবেন। একই ঘটনা বিরোধী দলের ক্ষেত্রেও ঘটে।
⇨ স্বাস্থ্য: ধরুন, আপনি বিশ্বাস করেন যে কোনো বিশেষ ডায়েট আপনার শরীরের জন্য সবচেয়ে ভালো। আপনি সে ডায়েটের পক্ষে সব ধরনের তথ্য এবং সাফল্যের কাহিনী খুঁজবেন, কিন্তু আপনি কখনোই সেই ডায়েটের বিপক্ষে কোনো গবেষণাকে গুরুত্ব দেবেন না।
⇨ ক্যারিয়ার: আপনার প্রফেশনাল জীবনেও কনফার্মেশন বায়াস প্রভাব ফেলতে পারে। আপনার যদি মনে হয়, "এই সেক্টরে কাজ করলে আমি সফল হবো", তাহলে আপনি সমস্ত সাফল্যের উদাহরণ এবং আপনার মতামতের পক্ষে প্রমাণ খুঁজে বেড়াবেন, কিন্তু বিপরীত তথ্য বা ফলাফলগুলোর দিকে মনোযোগ দেবেন না।
⇨ স্বাস্থ্য সচেতনতা: কেউ যদি বিশ্বাস করেন, ভেষজ ওষুধ সব রোগের সমাধান, তাহলে তারা আধুনিক চিকিৎসার বিপক্ষে তথ্যকেই বেশি গুরুত্ব দেন।
⇨ সোশ্যাল মিডিয়া: ফেসবুক বা ইউটিউবের অ্যালগরিদমও এই বায়াসকে শক্তিশালী করে তোলে—একবার আপনি যে ধরণের কনটেন্ট দেখেন, বারবার সেই ধরণের ভিডিও আপনার সামনে আসে।
✪ কনফার্মেশন বায়াসের ক্ষতিকর প্রভাব :
কনফার্মেশন বায়াস যদি অস্বাভাবিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তবে এটি আমাদের তথ্য প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতা এবং ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপকভাবে বিকৃত করতে পারে। এর ফলে:
⇨ পছন্দের তথ্য নিয়ে একপাক্ষিক চিন্তা: এই প্রবণতা আমাদেরকে বৈপরীত্য বা বৈচিত্র্যপূর্ণ তথ্য উপেক্ষা করতে বাধ্য করে। ফলে আমরা সবসময় আমাদের মতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ তথ্য পাই এবং এটি আমাদের চিন্তা এবং বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে।
⇨ সমাজে বিভেদ বৃদ্ধি: যখন আমরা শুধুমাত্র আমাদের মতের পক্ষে তথ্য গ্রহণ করি, তখন সমাজে বিভেদ সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক কিংবা সাংস্কৃতিক মতবিরোধ বৃদ্ধি পায়।
⇨ অপ্রাসঙ্গিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ: ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত জীবনে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে, কারণ আমরা আমাদের পক্ষের তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, অথচ বাস্তবতা থেকে এটি ভিন্ন হতে পারে।
✪ সমাধান কী?
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কনফার্মেশন বায়াস থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম ধাপ হলো নিজের এই প্রবণতাটি স্বীকার করা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, নতুন তথ্য গ্রহণ করার মানসিকতা এবং বিপরীত মতামত শোনার অভ্যাস আমাদেরকে কনফার্মেশন বায়াস থেকে মুক্তি দিতে পারে। অন্যদের মতামত এবং তথ্যের প্রতি আমাদের মনোভাব খোলামেলা এবং সবার কথা শোনা উচিত। এতে আমাদের চিন্তা আরো গতিশীল ও যৌক্তিক হবে। পাশাপাশি, সিদ্ধান্ত গ্রহণে আরো অধিক প্রমাণ ও বিচক্ষণতা থাকবে।
✪ শেষ কথা:
কনফার্মেশন বায়াস মানব মনের একটি শক্তিশালী এবং অদৃশ্য প্রভাব, যা আমাদের চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া প্রভাবিত করে। কিন্তু এর সচেতনতা এবং কিছু সহজ অভ্যাসের মাধ্যমে আমরা এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে পারি। সম্ভবত, একটু সতর্ক হলে এবং বৈজ্ঞানিক, যুক্তিপূর্ণ এবং বৈপরীত্যময় তথ্য গ্রহণ করলে আমরা আরও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবো।