বাংলাদেশের শিশুদের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স: এক ভয়াবহ সংকেত

বাংলাদেশের শিশুদের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স: এক ভয়াবহ সংকেত
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

বাংলাদেশে শিশুদের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্সের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। চিকিৎসকদের মতে, সাধারণ রোগেও অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করায় চিকিৎসা জটিল হয়ে উঠছে, যা ভবিষ্যতের জন্য এক অশনিসংকেত।

সম্প্রতি ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি থাকা আট বছর বয়সী এক শিশুর ঘটনায় বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। ইউরিন ইনফেকশনের কারণে ভর্তি হওয়া শিশুটির শরীরে ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়ে মাল্টিপল অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের চিকিৎসায় সাড়া না পাওয়ায় বর্তমানে তাকে তৃতীয় ধাপের ওষুধে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

"ইউরিন কালচারে ১৮টি অ্যান্টিবায়োটিক পরীক্ষা করা হয়, যার মধ্যে ১১টি কাজ করেনি। বাকি কয়েকটির মধ্যে একটি মোটেও কার্যকর হচ্ছে না," জানান শিশুটির মা তাসমিন নাহার মিথুন।

এ ধরনের ঘটনা একক নয়। ঢাকার এক নবজাতকের ক্ষেত্রেও প্রায় ১৮টি অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স ধরা পড়ে, যা চিকিৎসকদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে।

অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স কী?

অ্যান্টিবায়োটিক হল ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক বা পরজীবী ধ্বংস করার জন্য ব্যবহৃত ঔষধ। তবে যখন এগুলো যথাযথভাবে গ্রহণ করা হয় না, তখন জীবাণু এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তখন সেই ওষুধে আর কোনো কাজ হয় না—এই অবস্থাকেই বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স।

শিশুরা কেন আক্রান্ত হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্সে?

আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, অনেক শিশু অ্যান্টিবায়োটিক না খেলেও রেসিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া বহন করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বহু শিশু ভর্তি হওয়ার তিন মাস আগেও কোনো অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করেনি, তবুও তাদের শরীরে মাল্টি-ড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে।

এর অর্থ, পরিবেশ থেকেই এই জীবাণু শিশুদের শরীরে প্রবেশ করছে। গবেষকরা সতর্ক করে বলেন, "আমরা কেউই রেসিস্ট্যান্ট হয়ে জন্মাই না। শিশুদের মধ্যে এমন সংক্রমণ ভবিষ্যতের জন্য বড় হুমকি।"

অগ্রগতি ধীর, বিপদ দ্রুত :

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, একটি অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারে সময় লাগে গড়ে ১৫ বছর, অথচ একটি ব্যাকটেরিয়া মাত্র এক বছরেই সেই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রেসিস্ট্যান্স তৈরি করতে পারে। আগামী সাত বছরে দুইটির বেশি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আসার সম্ভাবনা নেই বলেও তারা জানান।

রেসিস্ট্যান্স ছড়াচ্ছে কোথা থেকে?

শিশুদের এই অবস্থা শুধুমাত্র জেনেটিক কারণে হচ্ছে না। খাদ্য ও পরিবেশের মাধ্যমেও রেসিস্ট্যান্স ছড়াচ্ছে। প্রাণীর মাংস, মাছ কিংবা সবজির উৎপাদনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হলে, তা মানুষের শরীরে রেসিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

"মানুষের প্রোটিনের চাহিদা পূরণের জন্য প্রাণীদের যত বেশি অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে, তা ভবিষ্যৎকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে," বলেন এক চিকিৎসক। এছাড়াও, রুগ্ণ ব্যক্তির হাঁচি-কাশি ও মল-মূত্র থেকেও জীবাণু ছড়াতে পারে।

করণীয় কী?

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা নিম্নলিখিত চারটি পদক্ষেপকে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স ঠেকাতে অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছেন:

⇨ প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধ করতে হবে।
⇨ সব অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের প্যাকেট লাল রঙে চিহ্নিত করতে হবে এবং অন্যান্য ওষুধ থেকে আলাদা রাখতে হবে।
⇨ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কখনোই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা যাবে না এবং পুরো ডোজ সম্পূর্ণ করতে হবে।
⇨ জ্বর, সর্দি, কাশি ও ডায়রিয়ার মতো সাধারণ অসুস্থতায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা উচিত নয়।

উপসংহার:
বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সচেতনতা ও সঠিক জ্ঞান ছাড়া ভবিষ্যতের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এক চরম সংকটে পড়বে। দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে, অদূর ভবিষ্যতে সাধারণ রোগেও প্রাণহানির আশঙ্কা অস্বীকার করা যাবে না।


সম্পর্কিত নিউজ