ফোন স্ক্রলিংয়ের নেশা , প্রযুক্তির অন্ধকার দিক

ফোন স্ক্রলিংয়ের নেশা , প্রযুক্তির অন্ধকার দিক
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

বর্তমান ডিজিটাল যুগে স্মার্টফোনের ব্যবহার আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং অবিরাম ব্যবহার আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুতরভাবে প্রভাবিত করছে। এক দিকে, এটি আমাদের যোগাযোগ, শিক্ষা এবং তথ্যের প্রবাহকে সহজ করেছে, অন্যদিকে, স্মার্টফোনের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতাই, যা "ফোন স্ক্রলিংয়ের নেশা" হিসেবে পরিচিত, তা আমাদের জীবনযাত্রাকে বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে।

ফোন স্ক্রলিংয়ের নেশা: কী?
ফোন স্ক্রলিংয়ের নেশা বলতে বোঝানো হয়, স্মার্টফোনে সোশ্যাল মিডিয়া, নিউজ ফিড, ভিডিও, ইন্টারনেট ব্রাউজিং বা অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অতিরিক্ত সময় ধরে স্ক্রল করতে থাকা। এটি একটি অভ্যস্ত আচরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে ব্যবহারকারীরা একে একে বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন বা সাইটের মধ্যে চলে যায়, অবশেষে অনেক সময় তারা নিজের অজান্তেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে স্ক্রল করতে থাকে। এটি শখ বা বিনোদন হিসেবে শুরু হলেও পরে এটি একটা মানসিক অভ্যেসে পরিণত হয়ে যায়, যা ধীরে ধীরে একজন ব্যক্তির দৈনন্দিন কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে।

কারণ ও প্রভাব:
মস্তিষ্কের পুরস্কৃত হওয়ার অনুভূতি
ফোন স্ক্রলিংয়ের নেশার একটি প্রধান কারণ হলো মস্তিষ্কে থাকা 'ডোপামিন' নামক রাসায়নিক পদার্থের মুক্তি। যখন আমরা সোশ্যাল মিডিয়াতে নতুন কিছু দেখার জন্য স্ক্রল করি, তখন আমাদের মস্তিষ্কে একটি পুরস্কৃত হওয়ার অনুভূতি আসে, যা আমাদের আরও স্ক্রলিং করতে উৎসাহিত করে। এই প্রক্রিয়া অনেকটা একটি নেশার মতো, যেখানে প্রতিবার কিছু নতুন পাওয়া গেলে মস্তিষ্ককে পুরস্কৃত মনে হয়।

শারীরিক প্রভাব:
অতিরিক্ত ফোন স্ক্রলিংয়ের কারণে শারীরিক সমস্যাও দেখা দেয়। দীর্ঘ সময় ধরে স্ক্রল করার ফলে চোখে সমস্যা যেমন: চোখের চাপ বৃদ্ধি, চোখের জ্বালা বা শুষ্কতা, মাথাব্যথা হতে পারে। এছাড়া, দীর্ঘক্ষণ ফোনে মনোযোগ দেওয়ার ফলে শারীরিক পেশী, বিশেষ করে ঘাড় ও পিঠের পেশীতে চাপ পড়ে, যা 'টেক্সট নেক' নামে পরিচিত।

মানসিক প্রভাব:
ফোন স্ক্রলিংয়ের নেশা মানসিকভাবে ক্ষতিকর হতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়াতে অবিরাম তুলনা করা, অন্যদের জীবনের সাফল্য বা বিলাসিতা দেখে নিজের জীবনের প্রতি হতাশা তৈরি হতে পারে। এর ফলে আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং মানসিক অবসাদ দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীরা নিজেদেরকে অন্যদের সাথে তুলনা করতে গিয়ে উদ্বেগ, মানসিক চাপ বা আত্মবিশ্বাসহীনতার শিকার হয়ে থাকে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত:
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এই নেশা দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকলে ডিপ্রেশন, এক্সাইটি (উদ্বেগ) এবং অন্যান্য মানসিক সমস্যার কারণ হতে পারে। শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে এটি তাদের শৈক্ষিক মনোযোগে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে এবং সামাজিক দক্ষতার অভাব তৈরি করতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে, যে ব্যক্তিরা দিনে ৩-৪ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ফোন স্ক্রলিং করেন, তাদের মধ্যে শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা প্রায়শই দেখা দেয়। বিশেষ করে যারা একাকিত্বের মধ্যে থাকেন, তারা অধিক সময় ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবেশ করতে পারেন, যা তাদেরকে আরও একাকী অনুভূত করতে সাহায্য করে।

কিভাবে এই নেশা কাটানো সম্ভব?
এমন পরিস্থিতিতে, বিশেষজ্ঞরা কিছু কার্যকর উপায় প্রস্তাব করেছেন, যা দিয়ে ফোন স্ক্রলিংয়ের নেশা কাটানো সম্ভব:

⇨ নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন: ফোন ব্যবহারের জন্য একটি সময়সূচী তৈরি করুন এবং সেটি অনুসরণ করুন। সপ্তাহে কিছু নির্দিষ্ট সময় ফোন থেকে বিরতি নিন।

⇨বিকল্প হিসেবে বই পড়া বা শখের কাজ: বই পড়া বা অন্য কোনো শখ বা শারীরিক কার্যকলাপে মনোযোগ দিন। এটি আপনার মনকে সতেজ করবে এবং ফোন থেকে দূরে রাখবে।

⇨মাইন্ডফুলনেস বা মেডিটেশন: মেডিটেশন বা মাইন্ডফুলনেস চর্চা করলে মানসিক চাপ কমতে পারে এবং ফোন স্ক্রলিংয়ের প্রতি নির্ভরশীলতা হ্রাস পেতে পারে।

⇨নোটিফিকেশন বন্ধ করুন: অপ্রয়োজনীয় নোটিফিকেশনগুলো বন্ধ করে দিন। এটি আপনাকে বারবার ফোন চেক করতে বাধ্য করবে না।

⇨ডিজিটাল ডিটক্স: প্রতি সপ্তাহে এক বা দুই দিন পুরোপুরি ফোন ব্যবহার থেকে বিরত থাকার অভ্যাস তৈরি করুন।

ফোন স্ক্রলিংয়ের নেশা আমাদের প্রযুক্তির সুবিধাকে অপব্যবহার করার ফলস্বরূপ একটি ভয়াবহ অভ্যেসে পরিণত হতে পারে। এটি আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে, তবে সচেতনতা এবং নিয়মিত পদক্ষেপের মাধ্যমে এর ক্ষতিকর প্রভাব কমানো সম্ভব। স্মার্টফোন ব্যবহারের সময়ের সীমা নির্ধারণ এবং সচেতনভাবে এটি ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা আরও স্বাস্থ্যকর এবং সুখী জীবন যাপন করতে পারি।


সম্পর্কিত নিউজ