ঘুমের অভাবেই ত্বকের বার্ধক্য ত্বরান্বিত! জানুন জৈবঘড়ির গোপন খেলা
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানুষের প্রতিটি দিন তার ঘুম দিয়ে পুনরায় শুরু হয়। শরীরের মৌলিক পুনর্গঠন, স্নায়ুতন্ত্রের স্থিতি, হরমোনের ভারসাম্য ও কোষের পুনরুদ্ধার সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হলো ঘুম। ত্বক–সংক্রান্ত সমস্যা, অকাল বার্ধক্য, ফোলা চোখ, অপুষ্ট বর্ণ, চামড়ার শুষ্কতা, ব্রণ বা প্রদাহ এসবের অনেক কিছুই শুরু হয় পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার কারণে। চর্মরোগ বিশেষজ্ঞরা বহু বছর ধরে সতর্ক করে আসছেন, ত্বকের যত্ন শুরু হয় রাতে। এই রাত মানে শুধু প্রসাধনী নয়; বরং নিখুঁত, পর্যাপ্ত ও স্বাভাবিক ঘুম। কিন্তু সমাজ যত ব্যস্ত হচ্ছে, প্রযুক্তি যত দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, মানুষের ঘুম ততই কমে আসছে। মোবাইল স্ক্রিনের আলো, মনোসংযোগের চাপ, মানসিক উদ্বেগ, অনিয়মিত জীবন সব মিলেই ঘুমের গুণমান নষ্ট হচ্ছে। আর তার সরাসরি প্রভাব প্রথমে দেখা দেয় ত্বকে।
ত্বক কেবল সৌন্দর্যের বিষয় নয়; এটি শরীরের সবচেয়ে বড় অঙ্গ, যার গুরুত্বপূর্ণ কাজ-
◑ বাহ্যিক বিপদ থেকে সুরক্ষা
◑ জলীয়বস্তু ধরে রাখা
◑ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
◑ রোগ প্রতিরোধে প্রথম প্রতিরক্ষা
◑ সংবেদনশীল অনুভূতি পৌঁছে দেওয়া
এই অঙ্গটি সারাদিন বহির্বিশ্বের চাপ সামলে রাতে পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে শক্তি ফিরে পায়। আর এই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি হলো ঘুম। রাতে গভীর ঘুমে থাকাকালীন ত্বকের কলাজেন তৈরি বাড়ে, কোষ বিভাজন ত্বরান্বিত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত চামড়া পুনর্গঠন হয়, রক্ত চলাচল বাড়ে, প্রদাহ কমে, হরমোন ভারসাম্য স্থিতিশীল হয়। যখন কেউ পর্যাপ্ত ঘুম পায় না, তখন এই প্রাকৃতিক পুনর্গঠন দুর্বল হয়ে ত্বকের ক্ষতি তাড়াতাড়ি দৃশ্যমান হয়।
মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গের মতো ত্বকেরও নিজস্ব জৈবঘড়ি আছে। দিন–রাত অনুযায়ী ত্বক ভিন্নভাবে কাজ করে।
দিনে ত্বকের কাজ:
⇨ সূর্যালোক, ধুলো, দূষণ থেকে সুরক্ষা
⇨ হরমোনের প্রতিক্রিয়ায় শক্তি ব্যবহার
⇨ পরিবেশগত ক্ষতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ
রাতে ত্বকের কাজ:
⇨ ক্ষত সারানো
⇨ নতুন কোষ তৈরি
⇨ পুষ্টি শোষণ
⇨ জলীয়তা ধরে রাখা
⇨ বার্ধক্য প্রতিরোধ
যখন কেউ রাতে ৬–৭ ঘণ্টার কম ঘুমায়, তখন এই জৈবঘড়ি বিঘ্নিত হয়। ফলে ত্বক সময়মতো পুনরুদ্ধার করতে পারে না। এটি ঠিক যেন মোবাইল চার্জ দিয়েও মাঝপথে খুলে নেওয়া, পরের দিন সেটি পুরোপুরি কাজ করতে পারবে না।
ঘুম কম হলে ত্বকের যে ক্ষতিগুলো হয়-
১) কলাজেন উৎপাদন কমে যায়, ত্বকে আসে ঢিলাভাব ও বলিরেখা। রাতে গভীর ঘুমের সময় শরীর কলাজেন তৈরি করে। ঘুম কম হলে—
◑ নতুন কলাজেন কম তৈরি হয়
◑ পুরোনো কোষ দ্রুত ভেঙে পড়ে
◑ ত্বক তার দৃঢ়তা হারায়
◑ মুখে সূক্ষ্ম রেখা দেখা দেয়
◑ অকাল বার্ধক্য গতিশীল হয়
বয়স বাড়ার সঙ্গে ঘুমের গুরুত্ব আরও বাড়ে, কারণ তখন স্বাভাবিকভাবেই কলাজেন কম তৈরি হয়।
২) কর্টিসল হরমোন বেড়ে গিয়ে ত্বকে প্রদাহ বাড়ায়! ঘুমের অভাব শরীরে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল বাড়িয়ে দেয়। এই হরমোন ত্বকে-
◑ প্রদাহ
◑ লালচে ভাব
◑ রুক্ষতা
◑ একজিমা বা সোরিয়াসিস বৃদ্ধি
◑ ব্রণ
-এসব সমস্যার সম্ভাবনা বাড়ায়। কর্টিসল বেশি হলে ত্বকের প্রতিরোধক্ষমতাও কমে, ফলে ছোট আঘাত বা ব্রণ হতে সময় লাগে বেশি সারতে।
৩) চোখের নিচে কালো দাগ, ফোলা ভাব ও নিস্তেজ চেহারা! ঘুম কম হলে রক্তচলাচল ব্যাহত হয়, চোখের নিচে ক্যাপিলারি ফুলে ওঠে। ফলে—
◑ ডার্ক সার্কেল
◑ মুখে ক্লান্ত ভাব
◑ ত্বক মলিন লাগে
এগুলো কেবল সৌন্দর্যগত সমস্যা নয়, বরং শরীরের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার দৃশ্যমান রূপ।
৪) ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়, ময়েশ্চার ব্যারিয়ার দুর্বল হয়! রাতে ঘুমের সময় ত্বক জলীয়তা ধরে রাখে। ঘুম কম হলে এই ব্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ত্বক শুষ্ক, খসখসে, ফাটা হতে থাকে। দীর্ঘমেয়াদে এটি ত্বকের প্রতিরক্ষা দেয়ালকেই দুর্বল করে দিতে পারে।
৫) রোগপ্রতিরোধক্ষমতা কমে ত্বক সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে! ঘুম কম হলে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়। ফলে ফাঙ্গাস, ব্যাকটেরিয়া, ত্বকের সংক্রমণ বাড়তে পারে। ত্বকে ক্ষুদ্র ক্ষত বা আঘাত সারতেও সময় বেড়ে যায়।
৬) হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে ব্রণ বেড়ে যেতে পারে! বিশেষ করে কিশোর ও তরুণদের জন্য ঘুম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঘুম কম হলে হরমোন ওঠানামা করে, ত্বকে তেল নিঃসরণ বেড়ে যায়। ফলে ব্রণ বাড়ে।এটি শুধু বাহ্যিক যত্ন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
ঘুমের অভাব শুধু ত্বক নয়,মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ! ত্বক–সমস্যা যদিও দৃশ্যমান, তবে এর পেছনে আরও বড় সমস্যার ইঙ্গিত থাকে-
⇨ স্নায়বিক চাপ
⇨ স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া
⇨ রোগ প্রতিরোধ কমে যাওয়া
⇨ ওজন বৃদ্ধি বা হ্রাস
⇨ হৃদ্রোগের ঝুঁকি
⇨ উদ্বেগ ও হতাশা
ঘুম কম হলে পুরো শরীরের কার্যক্ষমতা দুর্বল হয় এবং ত্বক সেটির প্রথম সতর্ক সংকেত দেয়।
সুস্থ ত্বকের জন্য কত ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন?
বিজ্ঞানীরা সাধারণত বলেন, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৭–৯ ঘণ্টা গভীর ঘুম আদর্শ। কিশোরদের জন্য ৮–১০ ঘণ্টা আর শিশুদের জন্য আরও বেশি প্রয়োজন। তবে শুধু সময় নয়, ঘুমের গুণমানও গুরুত্বপূর্ণ। ঘন ঘন জাগা, রাতজাগা অভ্যাস বা অনিয়মিত ঘুম ঘরের মতো সমস্যা ঘুম–চক্র নষ্ট করে।
ত্বকের জন্য ঘুমকে কার্যকর করতে যা করতে পারেন-
১) নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে ও উঠতে অভ্যাস করুন। জৈবঘড়ি ঠিক রাখতে এটি সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
২) ঘুমানোর ১ ঘণ্টা আগে মোবাইল ও স্ক্রিন দূরে রাখুন। প্রদর্শিত নীল আলো মস্তিষ্ককে জাগিয়ে রাখে।
৩) রাতে হালকা খাবার খান। অতিরিক্ত ভারী খাবার ঘুম ব্যাহত করে।
৪) ঘর কিছুটা ঠান্ডা ও আলো কম রাখুন। অন্ধকার মস্তিষ্কে মেলাটোনিন নিঃসরণ বাড়ায়।
৫) মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করুন। গভীর শ্বাস, ধীরে হাঁটা, হালকা পড়া ঘুমকে সহজ করে তোলে।
৬) ঘুমের ঠিক আগে ত্বকে হালকা ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন। ঘুমের সময় ত্বক আর্দ্রতা ভালোভাবে টেনে নেয়।
ত্বকের যত্ন শুধু বাহ্যিক ক্রিম, সিরাম বা রুটিনে সীমাবদ্ধ নয় বরং ত্বক সুস্থ রাখার মূল ভিত্তি হলো গুণগত ঘুম। ত্বক সারাদিন কাজ করে, ধুলো–ময়লা–সূর্যালোক–স্ট্রেস সবকিছু সামলায়। আর রাতে সে নিজের ক্ষতি সারায়। যখন ঘুম কম হয়, তখন ত্বক শুধু ক্লান্তই হয় না তাদের মেরামত প্রক্রিয়াই বন্ধ হয়ে যায়। তাই সুন্দর, উজ্জ্বল ও সুস্থ ত্বকের প্রথম শর্ত, সঠিক ঘুম। ঘুম ঠিক থাকলে ত্বক যেমন ভালো থাকে, তেমনি মন ও শরীরও থাকে সজীব, সতেজ ও শক্তিশালী।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।