শরীরের ভেতরে নীরবে বাড়তে থাকা ‘অন্য দেহ!-ডারময়েড সিস্ট নিয়ে চমকপ্রদ মেডিকেল তথ্য
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানুষের দেহকে নিয়ে প্রকৃতির বিস্ময়ের শেষ নেই। কখনো কখনো সেই বিস্ময় আমাদের কল্পনারও বাইরে চলে যায়। যেমন, এক তরুণীর খুব সাধারণ কিছু অসুবিধা-পেটের নিচে সামান্য ব্যথা, হালকা ভারী লাগা, যা দেখে অনেকেই গুরুত্ব দিতেন না। কিন্তু চেকআপে অবাক করা এক বাস্তবতা সামনে আসে। দেখা যায় ডিম্বাশয়ের ভেতর একটি টিউমার, যার মধ্যে মানুষের শরীরের মতো চুল, ত্বক, এমনকি দাঁতের মত গঠনের উপাদানও রয়েছে। প্রথম শুনলে বিষয়টি কল্পবিজ্ঞানের গল্পের মতো লাগলেও এটি শতভাগ বাস্তব। এর নাম ডারময়েড সিস্ট বা মেচিউর সিস্টিক টেরাটোমা।
এই টিউমারটি কোনো সংক্রমণ নয়, কোনো দুর্ঘটনা নয়, আবার গর্ভধারণের কোনো ভুলও নয়। এটি মূলত জার্ম সেল টিউমার, যা মানবদেহের এমন কোষ থেকে তৈরি হয় যেগুলো বিভিন্ন ধরনের টিস্যু তৈরি করতে পারে। এজন্য এর ভেতরে পাওয়া যায় ত্বক, চুল, চর্বি, ঘামগ্রন্থি, হাড় বা দাঁত, কখনো থাইরয়েড টিস্যু বা চোখের মতো গঠনযুক্ত অংশ পর্যন্ত! এটি সাধারণত ২০ থেকে ৪০ বছরের নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। ধীরে ধীরে বড় হয়, কিন্তু দীর্ঘসময় কোনো লক্ষণ প্রকাশ না করায় এটি দেহের ভেতর নিঃশব্দে বেড়ে উঠতে পারে।
কেন এটি হয়?
ডিম্বাশয়ে যে কোষ থেকে ভবিষ্যতে ডিম্বাণু তৈরি হতে পারে, সেই কোষের কিছু রয়েছে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন। এগুলোকে বলা হয় টোটিপোটেন্ট বা প্লুরিপোটেন্ট সেল। এদের আছে বিভিন্ন ধরনের মানুষের টিস্যু তৈরি করার ক্ষমতা। কোনো কারণে এসব কোষ সঠিকভাবে বিভাজিত না হয়ে গড়ে তোলে একটি টিউমার, যার ভেতর তৈরি হতে থাকে দেহের বিভিন্ন উপাদান। এ কারণেই ডারময়েড সিস্টকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অত্যন্ত অদ্ভুত অথচ পরিচিত টিউমার বলা হয়।
লক্ষণ:
অবস্থাটি ধীরে ধীরে তৈরি হয়, তাই উপসর্গগুলো প্রায়ই খুব সূক্ষ্ম—
⇨ পেটের নিচে সামান্য ব্যথা
⇨ ভারী লাগা
⇨ হালকা ফোলা
⇨ মাসিকের সময় অস্বস্তি
⇨ ঘনঘন প্রস্রাবের চাপ
⇨ কোমরের দিকটায় টান লাগা
অনেকে এগুলোকে দৈনন্দিন ক্লান্তি বা হরমোনজনিত দোষ মনে করে এড়িয়ে যান। কিন্তু সমস্যা হলো,এই সিস্ট বছরের পর বছর নীরবে শরীরের ভেতরে বাড়তে থাকে।
ডারময়েড সিস্টের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো টরশন, অর্থাৎ সিস্ট পাক খেয়ে ডিম্বাশয়কে ঘুরিয়ে ফেলা। এ অবস্থায় হঠাৎ তীব্র পেট ব্যথা, বমি, মাথা ঘোরা, ঠাণ্ডা ঘাম, এমনকি অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিও হয়। দ্রুত সার্জারি না করলে ডিম্বাশয়ের রক্তসরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং অঙ্গটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় তরুণীদের ভবিষ্যৎ প্রজননক্ষমতাও ঝুঁকির মুখে পড়ে।
এটি কী ক্যানসারে রূপ নেয়?
সাধারণভাবে ডারময়েড সিস্ট বহুতই সৌম্য (benign)। খুব কম ক্ষেত্রে সাধারণত বয়স বেশি হলে এটি ক্যানসারে রূপ নিতে পারে। তবে এমন ঘটনা অত্যন্ত বিরল। উপসর্গ না থাকলেও নিয়মিত আল্ট্রাসাউন্ড চেকআপ করলে এমন ঝুঁকি অনেকটাই কমে।
ডারময়েড সিস্ট কি গর্ভধারণের সঙ্গে সম্পর্কিত?
একেবারেই না। এটি কোনো অশ্লীলতা, অপরাধ, ধর্মীয় ব্যত্যয়, বা গর্ভধারণের ভুল নয়। মানবদেহের কোষের জৈবিক বৈচিত্র্যের কারণে এমন টিউমার তৈরি হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের সমাজ এটিকে এখনো লজ্জা, কুসংস্কার বা অপবাদ দিয়ে বিচার করে।
বৈজ্ঞানিক সত্য এবং সামাজিক বাস্তবতা!
অনেক নারী ডারময়েড সিস্ট ধরা পড়ার পর লুকিয়ে থাকতে চান। কারণ, অশুভ কিছু, গর্ভধারণের ভুল, খারাপ চরিত্রের প্রমাণ —এসব আজগুবি ধারণা এখনো সমাজে বেঁচে আছে। ফলে অসংখ্য তরুণী চিকিৎসা নিতে দেরি করেন, যার ফল ভয়াবহ হতে পারে। আমাদের বুঝতে হবে, ডারময়েড সিস্ট হলো এক ধরনের টিউমার, কোনো অপরাধ নয়।
কীভাবে ধরা পড়ে?
বেশিরভাগ সময় অন্য সমস্যার চিকিৎসা করতে গিয়ে এটি ধরা পড়ে-
◑ পেটের আল্ট্রাসাউন্ড
◑ পেলভিক পরীক্ষা
◑ সিটি স্ক্যান বা এমআরআই
চিকিৎসা সম্পূর্ণ নির্ভর করে সিস্টের আকার, অবস্থান এবং লক্ষণের উপর। সাধারণত সার্জারির মাধ্যমেই এটি অপসারণ করা হয়।
চিকিৎসায় দেরি কেন ক্ষতিকর?
যদি সিস্ট বড় হয়-
⇨ নিকটবর্তী অঙ্গগুলো চাপে পড়ে
⇨ ব্যথা বাড়ে
⇨ টরশনের ঝুঁকি বেড়ে যায়
⇨ কখনো ফেটে গিয়ে অভ্যন্তরীণ প্রদাহ সৃষ্টি করে। এক কথায়, যত দেরি হয়, ঝুঁকি তত বাড়তে থাকে ।
নারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা!
দেহ যে সংকেত পাঠায়, সেগুলোকে কখনোই অবহেলা করা উচিত নয়। বিশেষ করে—
◑ মাসিক চক্রে অস্বাভাবিক পরিবর্তন
◑ পেটের নিচে স্থায়ী ব্যথা
◑ অস্বস্তি
◑ হঠাৎ তীব্র ব্যথা
এসবকে সাধারণ ব্যথা ভেবে এড়িয়ে যাওয়া ভবিষ্যতে আরও বড় সমস্যার রূপ নিতে পারে।
ডারময়েড সিস্টের মতো টিউমার আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানবদেহ শুধু শারীরিক কাঠামো নয়; এটি কোষ, বিবর্তন, এবং জৈবিক বৈচিত্র্যের এক বিস্ময়কর জগৎ। কখনো কখনো সেই জগৎ এমন কিছু তৈরি করে, যা আমরা নিজ চোখে দেখলেও বিশ্বাস করতে পারি না।
নারীদের স্বাস্থ্য নিয়ে কুসংস্কার আমাদের সমাজে এখনো জেঁকে বসে আছে। কোনো স্বাস্থ্যসমস্যা হলেই দোষারোপ, অপবাদ, লজ্জা—এসবের বোঝা তারা আজও বয়ে বেড়ান। কিন্তু ডারময়েড সিস্ট এসবের কিছুই নয়। এটি একটি চিকিৎসাবিজ্ঞানে পরিচিত, বিরল হলেও স্বাভাবিকভাবে ঘটে যাওয়া টিউমার। স্বাস্থ্য সমস্যায় লজ্জা নয়, জ্ঞান জরুরি। কুসংস্কার নয়, প্রয়োজন সহমর্মিতা। অপবাদ নয়, প্রয়োজন সচেতনতা। নারী স্বাস্থ্য নিয়ে নীরবতা ভাঙতেই হবে। কারণ, দেহের ভেতরের রোগ লুকিয়ে রাখলে তা শুধু বিপদই বাড়ায়। সময়মতো চিকিৎসা নিলে ডারময়েড সিস্ট সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।