মানুষ ভয় পেলে চিৎকার করে-এ সত্য আমরা সবাই জানি কিন্তু কারণটা কি জানি!!

মানুষ ভয় পেলে চিৎকার করে-এ সত্য আমরা সবাই জানি কিন্তু কারণটা কি জানি!!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

অন্ধকার গলি দিয়ে হাঁটছেন, হঠাৎ পাশের বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে টিনের শব্দ- আপনি লাফিয়ে উঠলেন, হয়তো অজান্তেই গলা থেকে বেরিয়ে এল চাপা বা জোরে একটি চিৎকার।এই চিৎকার কখনো পরিকল্পিত নয়, কারও শেখানোও নয়, আর ইচ্ছা করলেই আটকানো যায় না। বিজ্ঞান বলছে, এটি একমাত্র আবেগ যা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে সবচেয়ে দ্রুত ঘটে। কারণ, ভয় মোকাবিলায় মানুষের শরীর এমনভাবে তৈরি যে চিৎকার হলো প্রথম প্রতিরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া।

ভয়ের সংকেত পাওয়া মাত্র মস্তিষ্কের ভেতরে কী ঘটে?

চোখ, কান বা ত্বক যেখান থেকেই বিপদের ইঙ্গিত আসুক না কেন, মস্তিষ্কের ভেতরে অ্যামিগডালা নামের ক্ষুদ্র অঙ্গটি ভয় শনাক্ত করে। এটি এত দ্রুত ঘটে যে মানুষ অনেক সময় বুঝতেও পারে না, তার দেহ ইতিমধ্যেই প্রতিক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে।অ্যামিগডালার কাজ বিপদ দেখলেই সাইরেন বাজানো। অ্যামিগডালা মনে করে, এখনই কিছু করতে হবে। হয় পালাও, না হলে নিজেকে রক্ষা করো। এরপর বিশাল এক রাসায়নিক প্রক্রিয়া ঝড়ে ওঠে অ্যাড্রেনালিন ঝড়ের মতো বাড়ে, হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়, ফুসফুসে বাতাস প্রবাহ বাড়ে, পেশি শক্ত হয়ে যায়, গলার স্বরযন্ত্রে চাপ পড়ে আর এই অতিরিক্ত চাপেই বেরিয়ে আসে চিৎকার। চিৎকার তাই কোনো দুর্বলতা নয় বরং শরীরের অভ্যন্তরীণ সতর্ক বার্তা।
 

গলার পেশি কেন হঠাৎ শক্ত হয়ে যায়- এটাই চিৎকারের মূল কারণ!

ভয় পেলে গলার আশপাশের স্নায়ু হঠাৎ সংকোচন করে। ফুসফুস থেকে বাতাস বের হয় দ্রুত, গলার স্বরযন্ত্র কাঁপে, স্বর উচ্চ হয়। এর ফলে চিৎকার বের হয় বিস্ফোরণের মতো। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ ভয় পেলে যে চিৎকার শোনা যায় তা সাধারণ কথার তুলনায় ৪–৭ গুণ জোরে। অনেক বেশি তীক্ষ্ণ আর এর শব্দতরঙ্গের আকৃতি আলাদা। এ কারণেই রাতের অন্ধকারে দূরে কোথাও কেউ চিৎকার করলে সেটি সহজেই কানে আসে।

মানবসভ্যতার শুরুতে মানুষ ছিল ভয়ংকর প্রাণীদের মুখোমুখি। জঙ্গলে বসবাসের সময় চিৎকার ছিল, ঝুঁকির খবর ছড়িয়ে দেওয়ার দ্রুততম উপায়। তখন কোনো ভাষা ছিল না, কিন্তু চিৎকার ছিল সবার বোঝা যায় এমন একটি সাধারণ সংকেত। বিবর্তনে যেসব আচরণ জীবন রক্ষায় সহায়তা করে, সেগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে টিকে থাকে। তাই মানুষের জিনেই রয়ে গেছে—বিপদ মানেই চিৎকার। এ কারণেই এখনো অন্ধকার ঘর, ট্রেনের ব্রেক, হঠাৎ ডাকা সবকিছুতেই মানুষ একইভাবে চমকে উঠে চিৎকার করে।

 

চিৎকার শুধু ভয় নয়, শরীরের SOS সিগন্যাল!

চিৎকার যখন ঘটে, তখন এটি তিনটি বড় উদ্দেশ্যে কাজ করে:

১. অন্যদের সতর্ক করা। ভয় দেখলে চিৎকার স্বয়ংক্রিয়ভাবে আশপাশের মানুষকে জানায়, এখানে বিপদ আছে! এটি মানুষকে দ্রুত একত্রিত করে।

২. আক্রমণকারীকে ভয় দেখানো। হঠাৎ তীক্ষ্ণ শব্দ অনেক প্রাণীকেই কিছুক্ষণের জন্য থামিয়ে দেয় বা ভয় পাইয়ে দেয়।মানুষের ক্ষেত্রেও এই প্রতিক্রিয়া জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

৩. শরীরকে ফাইট–অর–ফ্লাইট অবস্থায় পাঠানো। চিৎকারের সময় শরীর আরও সতর্ক হয়, চোখ বড় হয়, পেশি প্রস্তুত হয়। এটি শরীরের সামরিক প্রস্তুতির মতো।

 

বিজ্ঞানীরা বলছেন, চিৎকারের শব্দ মানুষকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে! সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ভয় পেলে মানুষের কণ্ঠস্বর এক ধরনের বিশেষ প্যাটার্নে ওঠা–নামা করে। এই প্যাটার্নকে বলা হয় নন–লিনিয়ার ভয় সিগন্যাল। এ ধরনের শব্দ মানুষের মস্তিষ্কে দ্রুত পৌঁছে। চারপাশের মানুষকে বেশি তাড়াতাড়ি প্রতিক্রিয়া করতে সাহায্য করে আর বিপদের সংকেত স্পষ্ট করে। সেই কারণেই চিৎকার শুনলে মানুষ দৌড়ে যায়, ফোন বের করে, লাইট জ্বালে বা সাহায্য চায়।
 

শিশুরা কেন দ্রুত চিৎকার করে?

শিশুর মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা পুরোপুরি গড়ে না উঠায় তারা ভয় পেলে দ্রুত ও উচ্চস্বরে চিৎকার করে। এটি তাদের বেঁচে থাকার স্বাভাবিক উপায়।চিৎকার করলে মা–বাবা দ্রুত কাছে আসে, নিরাপত্তা ফিরে পায়, বিপদ দূরে সরে যায় এবং লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, যে শিশুকে ভয় দেখানো হয় সে প্রাপ্তবয়স্কের তুলনায় বেশি জোরে ও দীর্ঘক্ষণ চিৎকার করে।
 

প্রাপ্তবয়স্করা কেন অনেক সময় ভয় পেলেও চিৎকার চেপে রাখে?

সবাই চিৎকার করে না। কারণ কিছু মানুষের মস্তিষ্ক সঙ্কট মুহূর্তে বোঝার অংশকে সক্রিয় করে, ফলে তারা চিৎকার না করে স্থির হয়ে যায়। এটি ব্যক্তিবিশেষের স্বভাব, অভ্যাস, পরিবেশ ও মানসিক নির্মাণের ওপর নির্ভর করে। তবে ভয় যখন অত্যন্ত হঠাৎ আসে, তখন প্রায় সবাই চিৎকার করে ফেলে—এটি রিফ্লেক্স।

চিৎকার শুধু ভয়ের প্রকাশ নয়, এটি শরীরকে রক্ষা করার কৌশল!

চিৎকারের সময় শরীরে এমন কিছু ঘটে যা অনেকেই জানেন না। চিৎকারের সময় শরীরের রক্তচাপ বাড়ে, চোখে আলো প্রবেশ ক্ষমতা বাড়ে, কান বেশি স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে, শরীরের ছোট পেশিগুলো সক্রিয় হয়, ব্যথা অনুভব কমে যায়, মানুষ মুহূর্তে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থাৎ চিৎকার হলো শরীরের ইমার্জেন্সি মোড অন করার সুইচ।

 

আধুনিক জীবনে হঠাৎ ভয়ে চিৎকার কমছে না, বরং বাড়ছে। শহুরে জীবনে লিফটের দরজা আটকে যাওয়া, রাস্তায় হর্নের শব্দ, হঠাৎ অন্ধকার, সিসিটিভি বা মোবাইলের পপ–আপ সাইরেন, ট্রেন–বাসের আকস্মিক ব্রেক, সিনেমা বা ভিডিওর জাম্প–স্কেয়ার এসবের কারনে মানুষের চমকে ওঠার পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়েছে। তাই  চিৎকারও আগের তুলনায় বেশি শোনা যায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ যত দ্রুতগতির জীবনে যাচ্ছে, ভয় এবং চিৎকার তত দ্রুতগতির হয়ে উঠছে।

 

মানুষ ভয় পেলে কেন হাসে বা কথা আটকে যায়?

চিৎকারের মতোই আরেকটি রিফ্লেক্স হলো ভয় পেলে অনেকে হাসতে থাকে। কারও গলা বন্ধ হয়ে যায়। কেউ আবার কথা বলতে পারে না। এগুলো মস্তিষ্কের অতিমাত্রার শক প্রতিক্রিয়া।
চিৎকার বের হতে না পেরে ভেতরে চাপ পড়ে গিয়ে হাসির রিফ্লেক্স সক্রিয় হয়।
 

চিৎকার কি ভয় কমায়?

হ্যাঁ, গবেষণায় দেখা গেছে, চিৎকার করলে দেহের স্ট্রেস হরমোন কমে, মনে চাপ কমে, শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়, ভয় থেকে মুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া দ্রুত হয়। এ কারণেই রোলার–কোস্টারে উঠলে মানুষ স্বেচ্ছায় চিৎকার করে  মুক্তির আনন্দ হিসেবে।

 

চিৎকার কি বিপদে সত্যিই কাজে লাগে?

চিৎকার এখনো মানুষের সবচেয়ে কার্যকর ‘এলার্ম সিস্টেম’। আজও কোনো দুর্ঘটনা, আগুন, ঝড়, হাতিছাড়া পরিস্থিতি, রাস্তায় বিপদ সব জায়গায় চিৎকারই প্রথম সংকেত। চিৎকার না থাকলে অনেক বিপদই মানুষ বুঝত না।

 

ভয় দেখলে চিৎকার করা আমাদের দুর্বলতা নয়, বরং শরীরের অত্যন্ত উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চিৎকার মানুষকে রক্ষা করেছে, বিপদের সংকেত দিয়েছে, একত্র করেছে, সতর্ক করেছে আর দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করেছে। আজকের আধুনিক পৃথিবীতেও চিৎকারের প্রয়োজন কমে যায়নি বরং দ্রুতগতির জীবনে এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ