পেয়ারার ভেতর লুকানো রোগপ্রতিরোধের শক্তি! দৈনন্দিন খাদ্যতালিকার এই সাধারণ ফলই হতে পারে স্বাস্থ্যরক্ষার ‘প্রাকৃতিক ঢাল’
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বাংলার বাজারে পাওয়া সবচেয়ে সস্তা অথচ স্বাস্থ্য গুণের দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী ফলগুলোর একটি হলো পেয়ারা। সাধারণ চোখে সাধারণ মনে হলেও খাদ্যবিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরেই পেয়ারাকে বলছেন প্রকৃতির তৈরি ভিটামিন, অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট ও মিনারেলে ভরপুর এক সুপারফুড। বর্ষা ও শরৎজুড়ে প্রচুর জন্মানো এই ফল সম্পর্কে মানুষ জানে সীমিত কিছু উপকারিতা; কিন্তু পেয়ারার ভেতরে লুকিয়ে থাকা স্বাস্থ্য–শক্তির পরিসর এতটাই বিস্তৃত যে বিশেষজ্ঞরা এটিকে শরীরের ‘নীরব রক্ষাকবচ’ বলতেও দ্বিধা করেন না। পুষ্টি–তত্ত্ব নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোর বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় পেয়ারা যুক্ত করা গেলে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হয়, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে, হজমশক্তি উন্নতি পায়, এমনকি কিছু দীর্ঘমেয়াদি অসুখের ঝুঁকিও কমে যায়। আর সবচেয়ে বড় বিষয়- পেয়ারার উপকারিতা পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক, কোনো ধরনের অতিরঞ্জন বা লোকচক্ষুর গল্প নয়।
পেয়ারার শরীর গঠনে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা একইসঙ্গে শক্তি দেয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। প্রতিটি উপাদানের কাজ আলাদা আলাদা পথ দিয়ে শরীরকে সুস্থ রাখে।
এতে রয়েছে ভিটামিন–সি’র শক্তিশালী উপস্থিতি!
পেয়ারা ভিটামিন–সি–এর জন্য পরিচিত। এতটাই পরিচিত যে অনেক পুষ্টিবিদ পেয়ারাকে ভিটামিন–সি’র ‘প্রাকৃতিক ভাণ্ডার’ বলেন। অনেক সময় একটা বড় পেয়ারা একটি মাঝারি আকারের কমলার চাইতেও বেশি ভিটামিন–সি সরবরাহ করতে পারে। ভিটামিন–সি মূলত অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। ফলে আমাদের শরীরের ভেতর যেসব ক্ষতিকর ফ্রি–র্যাডিক্যাল তৈরি হয়, তাদের প্রভাব কমিয়ে কোষকে সুস্থ রাখে।
উপকারিতা:
◑ ঠান্ডা–কাশির মতো সংক্রমণ কম হওয়া।
◑ ইমিউন সেলের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি।
◑ ত্বক স্বাস্থ্য ভালো থাকা।
◑ ক্ষত দ্রুত সারানো।
পেয়ারা খেলে শরীরে যেভাবে কাজ করে!
☞ ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। ভিটামিন–সি সাদা রক্তকণিকার কার্যক্ষমতা বাড়ায়।
সংক্রমণের সময় শরীর যে কোষগুলো পাঠায়, তাদের কাজ হয় আরও দ্রুত ও নির্ভুল। ফলে সাধারণ সর্দি বা ভাইরাল জ্বরের সময় শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও দক্ষ হয়ে ওঠে।
☞ রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। যে খাবার দ্রুত গ্লুকোজ বাড়ায় তাকে উচ্চ গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) বলা হয়। পেয়ারা GI–তে মাঝারি থেকে নিম্নমানের। এর খাদ্য–আঁশ রক্তে শর্করা ধীরে বাড়তে সাহায্য করে, ফলে ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনায় এটি অনেকের জন্য উপকারী ফল হিসেবে বিবেচিত।
☞ হজমশক্তি বাড়ায় ও কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়। আঁশ পানি শোষণ করে বড় আকার ধারণ করে এবং অন্ত্রকে সক্রিয় রাখে। নিয়মিত পেয়ারা খেলে কোলন–মুভমেন্ট স্বাভাবিক থাকে। যাদের দীর্ঘদিন কোষ্ঠকাঠিন্য, তাদের জন্য পেয়ারা প্রাকৃতিক সমাধান।
☞ রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে। পটাশিয়াম শরীরের সোডিয়াম–ব্যালান্স নিয়ন্ত্রণ করে। সোডিয়াম বেশি হলে রক্তচাপ বাড়ে, আর পটাশিয়াম এই চাপ কমিয়ে ভারসাম্য তৈরি করে।
☞ ত্বকের বয়স কমায়। অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট ত্বকের কোষকে ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করে। ফলে বলিরেখা বা নিস্তেজ ভাব কমে।
পেয়ারা কোন কোন রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে?
১. হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো। পেয়ারার ফাইবার ও অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট রক্তে লিপিড জমা কমাতে সাহায্য করে। নিয়মিত পেয়ারা খেলে রক্তচাপ কম থাকে এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে থাকে।
২. পাচনতন্ত্রের রোগের ঝুঁকি কমানো। আঁশ বেশি থাকায় অন্ত্রের জটিলতা, অম্লতা ও এসিডিটি কমাতে উপকারী। যাদের ইরিটেবল বাউয়েল সিনড্রমে (IBS) সমস্যা আছে, পরিমিত পেয়ারা তাদের আরাম দিতে পারে।
৩. ত্বক–সংক্রান্ত সমস্যা। ভিটামিন–সি কোলাজেন উৎপাদন বাড়ায়। এর ফলে ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা বাড়ে এবং ব্রণ–পরবর্তী দাগ কমে।
পেয়ারা খাওয়ার সঠিক নিয়ম-কখন, কীভাবে সবচেয়ে উপকারী?
১. দুপুর বা বিকেলে খাওয়া সবচেয়ে ভালো। এই সময় হজম শক্তি সবচেয়ে সক্রিয় থাকে। ফলে আঁশ ও ভিটামিনের শোষণ বেশি হয়।
২. সম্পূর্ণ পাকলে খাওয়া উত্তম। অপাকা পেয়ারা মাঝে মাঝে পেট ব্যথা বা অম্লতা বাড়াতে পারে।
৩. খোসাসহ খেলে উপকার বেশি। পেয়ারা–খোসায় ফাইবার সবচেয়ে বেশি থাকে। খাওয়ার আগে ভালোভাবে ধুয়ে নিলেই যথেষ্ট।
৪. অতিরিক্ত বীজ খাওয়া উচিত নয়। পেয়ারার বীজ শক্ত হওয়ায় অতিরিক্ত খেলে অনেকের হজমে সমস্যা হতে পারে। তবে স্বাস্থ্যবান ব্যক্তিদের জন্য মাঝারি পরিমাণ বীজ খাওয়া স্বাভাবিকভাবে ক্ষতিকর নয়।
পেয়ারা দিয়ে উপকারী ২টি ইউনিক রেসিপি-
➤ পেয়ারা–লেবু ডিটক্স স্মুদি (চিনি ছাড়া)-
এই স্মুদিটি শরীরে অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট প্রবাহ বাড়ায়, পেট ভরিয়ে রাখে এবং রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
যা লাগবে:
◑ পাকা পেয়ারা ১টি
◑ লেবুর রস আধা টেবিলচামচ
◑ ঠান্ডা পানি আধা গ্লাস
◑ ছোট্ট এক চিমটি লবণ
◑ ইচ্ছা হলে সামান্য মধু
প্রস্তুত প্রণালী:
১. পেয়ারার খোসা ছাড়াবেন না, শুধু ধুয়ে টুকরো করবেন।
২. বীজ মাঝেমাঝি রেখে ব্লেন্ডারে দেবেন (যদি হজমে সমস্যা থাকে তবে বীজ বাদ দিন)।
৩. লেবুর রস, পানি, লবণ যোগ করে ভালো করে ব্লেন্ড করুন।
৪. ছেঁকে খাওয়া যাবে বা ঘনভাবেই খাওয়া যায়।
উপকার: শরীর ঠান্ডা রাখে, ইমিউন শক্তি বাড়ায়, পেট ভরা রাখে বহুক্ষণ।
➤ গুড়–পেয়ারা সালাদ (উচ্চ আঁশ–সমৃদ্ধ)-
পেয়ারা, গুড় ও লেবুর ব্যালান্সে তৈরি দারুণ একটি সালাদ।
যা লাগবে:
◑ পাকা পেয়ারা ২টি
◑ তরল গুড় এক চা–চামচ
◑ লেবুর রস এক চামচ
◑ সামান্য লবণ
◑ কাঁচা মরিচ পাতলা কুঁচি (ইচ্ছা হলে)
প্রস্তুত প্রণালী:
১. পেয়ারাকে লম্বা বা চৌকো টুকরো করুন।
২. লেবুর রস আর গুড় একসঙ্গে মিশিয়ে হালকা ড্রেসিং তৈরি করুন।
৩. পেয়ারা টুকরো ড্রেসিংয়ের সঙ্গে মিশিয়ে ৫ মিনিট রেখে দিন।
৪. উপরে সামান্য লবণ ছিটিয়ে পরিবেশন করুন।
উপকার: চিনি ছাড়া মিষ্টির ভালো বিকল্প, পাচনশক্তি বাড়ায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
পেয়ারা নিয়ে কিছু সাধারণ ভুল ধারণা-
⇨ ভুল ধারণা ১: “পেয়ারা ঠান্ডা লাগায়।”
বাস্তবতা হলো পেয়ারা ঠান্ডা দেয় না; বরং ভিটামিন–সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
⇨ ভুল ধারণা ২: “পেয়ারার বীজ সবসময় ক্ষতিকর।”
বাস্তবতা- মাঝারি মাত্রায় একেবারেই ক্ষতিকর নয়। তবে যাদের পেটের সমস্যা আছে, তারা বীজ কম খেলেই ভালো।
⇨ ভুল ধারণা ৩: “পেয়ারা বেশি মিষ্টি, তাই ডায়াবেটিসে খাওয়া যায় না।”
বাস্তবতা- পেয়ারা কম GI–যুক্ত এবং আঁশ বেশি হওয়ায় ডায়াবেটিস রোগীদেরও পরিমিত পরিমাণে উপযোগী।
বাংলার মানুষের কাছে পেয়ারা শুধু সস্তা, সহজলভ্য একটি ফল নয় এটি আসলে এক শক্তিশালী প্রাকৃতিক ওষুধের মতো। এর ভিটামিন–সি শরীরকে ভাইরাস–জীবাণুর বিরুদ্ধে শক্ত করে, উচ্চ খাদ্য–আঁশ অন্ত্র ও হজমকে সক্রিয় রাখে, অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট আমাদের কোষকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করে, আর পটাশিয়াম নিয়ন্ত্রণে রাখে রক্তচাপ। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় মাত্র একটি পেয়ারা যোগ করলেই শরীরে নীরবে, ধীরে, নিয়মিত নানা ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। স্বাস্থ্যরক্ষার যুদ্ধে এই সাধারণ ফলই পারে বড় ভূমিকা রাখতে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।